জীবনী: বিস্তারিত

জন্ম ২ জানুয়ারি ১৯৪৬ সাল, ঢাকায়। বাবা ফজলুর রহমান, মা লুত্ফুননেসা বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর। পারিবারিকভাবে বামপন্থী রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। কবিতা, গান, চিত্রকলা আর খেলার মাঠ ছিলো তাঁর বিচরণের জগত। ১৯৬১ সালে নবাবপুর সরকারি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগসূত্রের হাতেখড়ি হয়েছে স্কুল ও কলেজে থাকাকালীন সময়ে ক্রিকেট খেলার মধ্য দিয়ে। সব রকমের খেলা নিয়ে আগাধ আগ্রহ ছিল। সেই সময়ের আলোচিত ক্রিকেট দল ভিক্টোরিয়ার অধিনায়ক ছিলেন দুই বছর। ১৯৬১ সালের একদম শেষের দিকে গোপন সাম্যবাদী আন্দোলনে যুক্ত হন। সে সময়ের বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক।

বামপন্থী রাজনৈতিক যোগাযোগের সূত্রে বাষট্টির ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিন থেকে প্রতিটি কর্মসূচিতে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যুক্ত হন। যুক্ত ছিলেন উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত ছোট ছোট কাজ থেকে শুরু করে ছাত্ররাজনীতির বড় বড় নানা কার্যক্রমে। লিখেছেন লিফলেট, ছাপিয়েছেন পোস্টার, বিলি করেছেন ঝুঁকি নিয়ে, আন্দোলন সংগঠনে গোপন যোগাযোগ চালু রেখেছেন, অংশ নিয়েছেন উত্তাল দিনগুলোর মিছিলে সবচেয়ে পেছনের সারিতে। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের সময় মানুষের জন্য কবিতা আর গণসংগীতের দুয়ার উন্মোচিত হয় মতিউর রহমানের সামনে। সুকান্ত ভট্টাচার্য আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়, শেখ লুত্ফর রহমান, আলতাফ মাহমুদ প্রমুখের গানে উজ্জীবিত তরুণদের কাছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার উত্স।

’৬২ থেকে ’৭০ পর্যন্ত প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উপলক্ষে সংকলন প্রকাশনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে লেখক-কবি-শিল্পীদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়। তখন কবিতা লেখা শুরু হয়। শুরু হয় কবিতা পাঠ। তেষট্টিতে কার্জন হলে ডাকসুর আয়োজনে একুশের অনুষ্ঠানে পাঠ করেন প্রথম স্বরচিত কবিতা।

ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হন চৌষট্টির একুশে ফেব্রুয়ারিতে ডাকসুর উদ্যোগে শহীদ মিনারে একুশের প্রথম অনুষ্ঠানের আয়োজনে। সামনাসামনি বসে বা খুব কাছ থেকে সাক্ষাৎ ও পরিচয় ঘটে আলতাফ মাহমুদ, জাহেদুর রহীম, অজিত রায়, ফাহমিদা খাতুন প্রমুখের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন সে সময়ের সংস্কৃতিজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তি ওয়াহিদুল হক, সন্‌জীদা খাতুন আর কামাল লোহানীর সঙ্গেও।

সেসব দিনে ঢাকার রাজপথের সব আন্দোলন কর্মসূচি আর গভীর রাত পর্যন্ত গোপন রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম একসঙ্গে চলেছেন প্রতিদিন। তখন থেকেই সব রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। করেছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, প্রকাশ করেছেন সংকলন আর আয়োজন করেছেন সেমিনার। দেশের সেরা কবি, লেখক, গায়ক ও চিত্রশিল্পীদের যুক্ত করতে পেরেছিলেন তাঁরা। নিজে যখন লিখেছেন, তখন সাহায্য পেয়েছেন সুফিয়া কামাল, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, শামসুর রাহমান, জহির রায়হান, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আনিসুজ্জামানসহ সেরা সব লেখকের কাছ থেকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের দেশ’সহ বেশ কয়েকটি নাটক অত্যন্ত সফলভাবে মঞ্চস্থ করায় যুক্ত ছিলেন মতিউর রহমান। পরিচালনা ও অভিনয়ে ছিলেন গোলাম মুস্তাফা, মাসুদ আলী খান, হাসান ইমাম, লায়লা হাসান, আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, ইনামুল হক প্রমুখ। এখনো তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সেরা ব্যক্তিত্ব। অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠতার মাঝে রণেশ দাশগুপ্তকে তিনি নিজ জীবন আর কর্মের পথিকৃৎ বলে মনে করেন।

ষাটের দশকজুড়ে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভাষার অধিকার, সুস্থ সংস্কৃতি আর গণতন্ত্রের দাবিতে দেশব্যাপী প্রবল গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তার পেছনে সে সময়ের ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সংস্কৃতি সংসদ’ বড় ভূমিকা পালন করেছে। আর এই সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন মতিউর রহমান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সংগঠনের আমন্ত্রণ ও পেশাগত দায়িত্বে ভ্রমণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, পর্তুগাল, মিশর, ফিলিপাইন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ।

প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্র ধরে লেখালেখির সূচনা ঘটে। পত্রিকা, রাজনৈতিক বক্তব্য জনমানুষের কাছে প্রচার এবং সাহিত্য পত্রিকায় লেখার পথ ধরে পেশাদার সাংবাদিকজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘একতা’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে। ২০ বছর একতার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ৭০–এর দশকে প্রাগ থেকে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড মার্কসিস্ট রিভিউ’র বাংলাদেশ সংস্করণ ‘মুক্তির দিগন্ত’ প্রকাশ করেছেন পাঁচ বছর। বাংলাদেশে সংবাদপত্রের প্রথাভাঙা যাত্রা শুরু করে ১৯৯২ সালে দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’-এর সম্পাদক হন (ফেব্রুয়ারি ১৯৯২—আগস্ট ১৯৯৮)। ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর ‘প্রথম আলো’র প্রথম সংখ্যা বের হয়। এখন সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রথম আলো অনলাইন, মাসিক ‘কিশোর আলো’, ‘বিজ্ঞান চিন্তা’ ও ‘চলতি ঘটনা’, ত্রৈমাসিক ‘প্রতিচিন্তা’ এবং প্রথমা প্রকাশন ও এবিসি রেডিওর মতো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অগ্রগামী উদ্যোগসমূহ।

১৯৫০ আর ৬০-এর দশকে দৈনিক ‘সংবাদ’, দৈনিক ‘ইত্তেফাক’, ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ এবং আরও কিছু পত্রিকা দেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, ‘প্রথম আলো’ সেই মহান ঐতিহ্যের স্বাভাবিক উত্তরাধিকার বহন করে জন্ম নিয়েছে। প্রতিষ্ঠাকাল হতে দৈনিক ‘প্রথম আলো’কে স্বাধীন, পক্ষপাতহীন আর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলায় তিনি ভূমিকা পালন করেন। ‘প্রথম আলো’ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে একটা সহজ দর্শন গ্রহণ করেছে, আর তা হলো বৈচিত্রের মাধ্যমে সংবাদপত্রকে টেকসইভাবে টিকিয়ে রাখা। প্রিন্ট মিডিয়া যে নতুন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার তা সমাধানের অন্যতম একটি মাধ্যম হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।