প্রিন্ট আর ডিজিটালের সমন্বয়ের মধ্যেই সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিহিত
‘আইস বিজনেস টাইমস’-এর দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর পেশাজীবন আর প্রথম আলোর সফল যাত্রা সম্পর্কে বিশদ জানা। সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ ‘আইস বিজনেস টাইমস’–এর অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তওহিদুর রশিদ।
প্রথম আলোর এক দীর্ঘ ধারাবাহিক যাত্রার ইতিহাস আছে। বলাই যায়, পত্রিকাটি সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছে। তৈরি করেছে সাংবাদিকতার নতুন পথ। কীভাবে আপনি এই যাত্রার যাত্রী হতে উদ্বুদ্ধ হলেন?
যখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি, ঠিক এই সময়টাতেই আমরা প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। তারিখ হচ্ছে এ বছরের ৪ নভেম্বর। এ এক অসাধারণ পথচলা। সাফল্য নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি। বরং এক ভীতি সর্বদা তাড়া করে ফিরত আমাকে। যা করতে হবে, আমি তা ক্লান্তিহীনভাবে করে গেছি। বলতে দ্বিধা নেই যে, পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ছাপা হওয়ার আগেই এই চাপে আমার ওজন কমে গিয়েছিল। আমার রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল, আর অন্যান্য শারীরিক সমস্যা তো ছিলই। একটা আশঙ্কা যেন আমার ওপর চেপে বসেছিল। সব রকম সামাজিক যোগাযোগে এর ছাপ পড়েছিল। এমনকি স্বাভাবিকভাবে হাসতেও যেন ভুলে গিয়েছিলাম। এই অনিশ্চিত যাত্রা নিয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। শুধু জানতাম আমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে। একটা ভালো পত্রিকা বের করতে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা দিতে হবে। সেই পত্রিকা হবে পক্ষপাতহীন, ধারণ করবে সত্য আর সাহসের কণ্ঠস্বর। সেই পত্রিকা যে কালে কালে প্রচার আর প্রভাবের বিচারে এমন সফল হবে, তা আমি কখনো ভাবিনি।
পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আমার জীবন শুরু হয় ১৯৭০-এর জুনে সাপ্তাহিক পত্রিকা একতার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে। এটা ছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র। পরে সেই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি ১৯৯১-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত। আরও পেছনে তাকালে দেখবেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। সামরিক শাসনবিরোধী এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি। এই আন্দোলনের প্রায় সব রকমের কাজে আমি যুক্ত ছিলাম। কখনো লিফলেট লিখছি, লিফলেট বিলি করছি, পোস্টার ছাপাচ্ছি, কখনো-বা মিছিল করছি। তবে মিছিলে আমি থাকতাম একদম পেছনের দিকে। স্লোগান বা রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস আমার ছিল না। প্রায় তিন দশক সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলাম, কিন্তু কখনো কোনো মঞ্চে বক্তৃতা দিইনি।
ছাত্রকাল থেকেই সব রকম খেলাধুলায় আমার আগ্রহ ছিল প্রবল। ক্রিকেট খেলতাম। আমার আগ্রহ আর সক্রিয়তা ছিল নানা বিষয়ে। পড়তে ভালোবাসতাম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলাম আর রাজনীতি তো ছিলই। সেই সঙ্গে একটু-আধটু লিখতাম, ২১ ফেব্রুয়ারিসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন রকম প্রকাশনা বের করার কাজে যুক্ত ছিলাম প্রায় আট বছর ধরে। সংস্কৃতি সংসদ (১৯৬৮ এবং ১৯৬৯) থেকে দুটি বিশেষ পুস্তিকা বের করেছিলাম ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে। ফলে ১৯৭০ সালে সরাসরি সাংবাদিকতায় আসার আগেই সেই জগতের নানা দিকের সঙ্গে আমার সংযুক্তি ছিল। ১৯৭০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত আমি সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম। ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা আর পরে সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতার দায়িত্ব পালন করি প্রায় ২০ বছর।
১৯৯২ সালে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর সম্পাদক হই (ফেব্রুয়ারি ১৯৯২-আগস্ট ১৯৯৮) আর ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রথম সংখ্যা বের হয়। যেমন বলেছি, এটা ছিল অনিশ্চয়তায় ঢাকা এক যাত্রা। এর ফল কী হবে আমি তার কিছুই জানতাম না। ভোরের কাগজের আগে দৈনিক পত্রিকা চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ছিল শুধু উদাহরণ দেওয়ার মতো ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা।
ভোরের কাগজে ছিলাম ছয় বছর। সেই সময়ের মধ্যে একটা পত্রিকার পুরো পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা, সম্পাদনার কাজ শিখে উঠতে পারিনি। সাপ্তাহিক আর দৈনিক পত্রিকা চালানোর মধ্যে অনেক ফারাক। প্রথম আলোর কাজের ব্যাপ্তি সেই তুলনায় বিশাল। প্রথম সংখ্যাই ছাপা হলো এক লাখ কপির বেশি! দিনে দিনে সেই সংখ্যা আরও বাড়ল। আজকে ছাপা সংস্করণ (৬৬ লাখ) আর অনলাইন (১০ লাখ) মিলিয়ে প্রতিদিন ৭৬ লাখ পাঠক প্রথম আলো পড়ে। এ এক বিশাল যাত্রা। পথ চলতে চলতে শেখা।
সব অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও দুটি সিদ্ধান্তে আমরা অবিচল ছিলাম। আর তা হলো, এই পত্রিকাকে এক নম্বর পত্রিকা করতে হবে আর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে। যদি তা কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দল বা সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে, তাহলে কালের বিচারে এর কোনো মূল্য থাকবে না। তখন এর কোনো স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। প্রতিষ্ঠাকাল হতে আমাদের মৌলিক নীতি ছিল যে, প্রথম আলোকে হতে হবে স্বাধীন, পক্ষপাতহীন আর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।
প্রায় চার বছরে আমরা ব্রেক ইভেনে পৌঁছে গেলাম। সম্ভবত বাংলাদেশে কোনো পত্রিকার জন্য এটাই এমন প্রথম দৃষ্টান্ত। এরপর থেকে আমরা একে স্বাবলম্বী রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এ ক্ষেত্রে একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেই হবে। আমাদের দেশে ছাপা প্রচারমাধ্যমের খুব সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। ১৯৫০ আর ৬০-এর দশকে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার এবং আরও কিছু সমীহ আদায় করার মতো পত্রিকা চালু ছিল। আমাদের দেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে সংবাদপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম আলো সেই মহান ঐতিহ্যের স্বাভাবিক উত্তরাধিকার বহন করে জন্ম নিয়েছে। প্রথম আলো অনেকের সম্মিলিত অবদানের ফল।
আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে মিডিয়া স্টার লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠানকে আমাদের মূল কোম্পানি হিসেবে পেয়েছি, যার কর্ণধার আমাদের চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) লতিফুর রহমানের মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সাংবাদিকতা আর আর্থিক বিষয়গুলো পরিচালনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের তাঁরা দিয়েছেন। সেই দূরদর্শিতা তাঁদের আছে। আমাদের সাফল্যের এটা একটা অন্তর্নিহিত বড় কারণ।
প্রথম আলো নিজেকে এক উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। মানুষ এখন এর উদাহরণ দেয়। কিন্তু শুরুর সময় আপনাদের সামনে কোনো উদাহরণ ছিল? আর আপনাদের প্রধান কোম্পানি কী ধরনের স্বাধীনতা দিয়েছিল, সে বিষয়ে যদি বিস্তারিত বলতেন?
বাংলাদেশে সব সময়েই আর্থিকভাবে সফল পত্রিকা ছিল, এ কথা ভুললে চলবে না। দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৬০ থেকে ৮০ পর্যন্ত লাভজনক ছিল। ১৯৬০ থেকে ৮০-এর দশকে বাংলাদেশ অবজারভার তাই ছিল। এখনো কয়েকটি স্বাবলম্বী পত্রিকা আছে।
আমাদের কোনো বিশেষ বিজনেস মডেল ছিল না। আর সাংবাদিকতা ও প্রকাশনা বিষয়ে আমার কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণও ছিল না। ব্যবসা নিয়ে কোনো পড়ালেখা করিনি। কোনো অভিজ্ঞতাও ছিল না। এ ব্যাপারে আমার একমাত্র অভিজ্ঞতা হচ্ছে ১৯৯৫-এ একটা সেমিনারে অংশগ্রহণ। সেমিনারের বিষয় ছিল ‘মাঝারি ও ছোট সংবাদপত্রের প্রচার ও বিজ্ঞাপনের আয় কী করে বাড়াতে হয়’। সাংবাদিকতার জীবনে এই ছিল আমার একমাত্র প্রশিক্ষণ। আর যা কিছু শিখেছি, তার সবই নিজ চেষ্টায় শেখা। প্রতিদিন চলতে চলতে শেখা।
সংবাদপত্রকে অর্থনৈতিকভাবে সফল হতে হলে প্রচারসংখ্যা বাড়াতে হবে, এর ফলে বিজ্ঞাপনের আয়ও বাড়বে। শুধু পত্রিকা বিক্রি করে পত্রিকা চলে না। এ থেকে মোট ব্যয়ের ১/৪ ভাগ মাত্র আসে। বাকিটা আয় করতে হয় বিজ্ঞাপন থেকে। আর বিজ্ঞাপন তখনই আসবে, যখন সেই পত্রিকার প্রচারসংখ্যা থাকবে সবচেয়ে বেশি। এ জন্যই আমরা শুরু থেকেই সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা হওয়ার লক্ষ্য গ্রহণ করি। বলতে পারেন, এই ছিল আমাদের বিজনেস মডেল।
এখনো আমার সহকর্মী আর আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মামলা চলছে। এ জন্য আমাদের কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। প্রায়ই আমাদের একরকম ভয় আর অনিশ্চয়তায় মধ্য দিয়ে চলতে হয়। এর মধ্যে বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় যেন আমাদের বিজ্ঞাপন না দেয়। এ রকম সব চ্যালেঞ্জ আমাদের নিয়মিত সামলাতে হয়। তবে এসব আমাদের কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিতে হয়। এত সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমাদের যা করা উচিত বলে ঠিক করেছি, তা করে যেতেই হবে।
আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ প্রসঙ্গে বলা যায়, আমাদের মূল কোম্পানির দূরদর্শিতা। তাঁরা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন বলে আমরা কাজ করে শিখে নিজেদের বড় করতে পেরেছি। বিজ্ঞাপনদাতা, বিতরণকারী, বিক্রেতা—এ রকম সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে যত কথা বলেছি, পত্রিকার প্রাত্যহিক কাজকর্মের ব্যাপারে আমার ধারণা তত স্বচ্ছ হয়েছে।
আপনার এই অভিযাত্রায় কোনটিকে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে বিবেচনা করেন? তাকে অতিক্রমই-বা করলেন কী করে?
পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে সাংবাদিকতার সামনে বাধা আসে না। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমার মনে পড়ে, ১৯৭৫ সালে একতাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে আবার ছাপা শুরু হয়। চালু হওয়ার পর এরশাদ সরকার আবার তা দুই বছরের জন্য বন্ধ করে দেয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার ভোরের কাগজে সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। আমরা তখন রাজপথে নেমেছিলাম। শেষে সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ২০০০ সালে প্রথম আলো একই পরিস্থিতিতে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আবার সেই অবস্থায় পড়ি আমরা। ফলে দেখতেই পাচ্ছেন যে বিগত বছরগুলোতে আমরা অনেকবার এমন অবস্থার মুখে পড়েছি। এমনকি এখনো আমার সহকর্মী আর আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মামলা চলছে। এ জন্য আমাদের কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। প্রায়ই আমাদের একরকম ভয় আর অনিশ্চয়তায় মধ্য দিয়ে চলতে হয়। এর মধ্যে বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় যেন আমাদের বিজ্ঞাপন না দেয়। এ রকম সব চ্যালেঞ্জ আমাদের নিয়মিত সামলাতে হয়। তবে এসব আমাদের কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিতে হয়। এত সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমাদের যা করা উচিত বলে ঠিক করেছি, তা করে যেতেই হবে। আর তা করতে হবে সবচেয়ে ভালোভাবে।
আরও কিছু বড় সমস্যা রয়েছে। যেমন সংবাদমাধ্যমের জন্য সাংবাদিকসহ উপযুক্ত কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দিন শেষে বাংলাদেশে ছাপা বা গণমাধ্যম—যা-ই বলুন, মিডিয়া তেমন সফল নয়; যেমনটা ধরা যাক ভারতে। এসব সমস্যা একেবারে সমাধান করা যায়নি। আমি নিজে সাংবাদিক, সংবাদদাতা আর সাধারণ পাঠকদের কাছে যাই। শুনতে চাই তাঁরা কী বলেন।
ছাত্র বয়স থেকেই একভাবে দৈনিক সংবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সংবাদ আর অন্যান্য সাপ্তাহিকে নিয়মিত কলাম, প্রতিবেদন লিখেছি। সেই তুলনায় আমার কোনো ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার একমাত্র সম্বল ছিল দুই দিনের একটি সেমিনার, যা আগেই বলেছি। ২০১০ সালের পর আমরা ভারতে বেশ কয়েকটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করি। বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক আর সংবাদপত্র পেশাজীবীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি। এসব অভিজ্ঞতা আর নিজেদের মধ্যে অনেক আলাপ-আলোচনা থেকে প্রথম আলোর ব্যবসায়িক নীতি গড়ে ওঠে। আমরা একটা সহজ দর্শন গ্রহণ করেছি। আর তা হলো, বৈচিত্র্য একটা সংবাদপত্রকে টেকসইভাবে টিকে থাকতে সহায়তা করতে পারে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম টেকসই হওয়া এমন আরও একটা উদাহরণ। বোধ হয় ডিজিটাল হওয়াই এগিয়ে যাওয়ার পথ। প্রিন্ট মিডিয়াকে নতুন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আর ক্রমবর্ধমান অনলাইন উপস্থিতি হয়তো এর সমাধান হতে পারে।
আমরা এই পরিপ্রেক্ষিতে বোধ হয় আমাদের কিছু প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে কিছুটা এগিয়ে আছি। আমাদের মূল কোম্পানি মিডিয়া স্টার লিমিটেড আরও দুটি মাসিক পত্রিকা বের করে। কিশোর-তরুণদের জন্য কিশোর আলো আর তরুণ বিজ্ঞানমনস্কদের জন্য বিজ্ঞানচিন্তা। এর সঙ্গে ত্রৈমাসিক জার্নাল প্রতিচিন্তা ছাপা হয়। আরেকটা উদ্যোগ হলো প্রথমা প্রকাশন। প্রথমা ইতিমধ্যে ৫০০-এর অধিক বই প্রকাশ করেছে। আমরা সমমনা জাতীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বড় বড় অনুষ্ঠানও আয়োজন করে থাকি। এসব কিছুর লক্ষ্যই থাকে কিশোর ও তরুণ, ছাত্র এবং পেশাজীবীরা।
বাংলাদেশে prothomalo.com সবচেয়ে বেশি ভিজিট হওয়া অনলাইন পোর্টাল। এটা বিশ্বের এক নম্বর বাংলা ওয়েবসাইট। এ ছাড়া আমাদের ইংরেজি পাঠকদের জন্য আছে en.prothomalo.com নামে ইংরেজি পোর্টাল। ফেসবুকে আমাদের ফলোয়ার ১ কোটি ৪৪ লাখ, টুইটারে ১৪ লাখ আর ইউটিউবে ১৩ লাখ। অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও লক্ষণীয় উপস্থিতি আছে। এসবই ওয়েবে আমাদের শক্ত অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। এই ওয়েব উপস্থিতিকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের সব সময় বিকল্প আর নতুন পথের অনুসন্ধান জারি রাখতে হবে।
আপনি একটা চমৎকার বিষয় উত্থাপন করেছেন। আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে প্রিন্ট মিডিয়া মুমূর্ষু অবস্থায় আছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ কী বলে আপনার মনে হয়?
ছাপা পত্রিকা মরে যাচ্ছে—এমন অভিধার পক্ষে আমি নই। আমি আগেও বলেছি যে সংবাদপত্রশিল্প নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। আমরাসহ সারা বিশ্বের প্রকাশক, সম্পাদক আর সাংবাদিকেরা নতুন নতুন কনটেন্ট সংযুক্ত করে একে প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আরও বেশি মানুষের কাছে যাতে এর চাহিদা বাড়ে, তার জন্য কনটেন্ট, প্রতিবেদন, ফিচার, কলাম আর লেখার ধরনের মান বাড়াতে হচ্ছে। সমকালীনতাকে ধারণ করে পাঠকদের আমাদের সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে। পাঠককে শুধু সংবাদ দিলে আর চলবে না। সেই সঙ্গে অবশ্যই মতামত আর বিশ্লেষণ দিতে হবে। পাঠকের সংখ্যা যাতে না কমে, সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু বাস্তবে দুনিয়াজুড়েই প্রিন্ট মিডিয়ায় একটা ভাটার টান শুরু হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাবলম্বী থেকে প্রিন্ট মিডিয়াকে প্রাসঙ্গিক রাখতে আমরা বহু প্রতিকূলতার মোকাবিলা করছি। সবশেষে বলব, প্রিন্ট মিডিয়া প্রাসঙ্গিক থাকবে, কারণ ‘ছাপাই প্রমাণ’।
সেই সঙ্গে একটা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থান আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না। এটা এক বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করছে। বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ সংবাদ মোবাইল ফোনে পাঠ করা হয়। এটাই এখন দ্রুততম মাধ্যম। মানুষ তাই একেই বেছে নিচ্ছে। ফলে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতার দিকে সজাগ নজর রাখতে হবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রিন্ট আর ডিজিটালের সমন্বয়ের মধ্যেই সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিহিত। সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা আছে, তবে সাংবাদিকতার ইতিবাচক ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ছাপা, অনলাইন বা অন্য যে মাধ্যমই হোক, সংবাদ আর সাংবাদিকতা থাকবেই। এ জন্যই আমাদের সাংবাদিকতায় বিনিয়োগ করতে হবে।
কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু নামে নতুন একটি শব্দ আজকাল বাতাসে ভাসছে। এই কনটেন্ট ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন? ভালো কনটেন্টের বৈশিষ্ট্য কী?
আজকাল সাংবাদিকতার প্রতিটি অংশ—সে সংবাদ, কলাম, সাক্ষাৎকার, বিশ্লেষণ—যা–ই হোক না কেন, তা মূলত কনটেন্ট। স্মার্টফোনের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। পাঠকের হাতে হাতে কনটেন্ট পৌঁছে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। আর আপনি একে কনটেন্ট বলুন বা সংবাদ বলুন, এর বৈচিত্র্য অনেক। ছাপা হোক আর সম্প্রচার হোক, একে যথাযথভাবে সম্পাদনা করতে হবে। এই পরিবর্তনশীল কনটেন্টের উপস্থাপনের বৈচিত্র্যের বিবেচনায় আজকের সাংবাদিকের দক্ষতা আর সক্ষমতাও অনেক বেশি হওয়া চাই। প্রাথমিক সংবাদ কনটেন্ট তৈরি হতে হবে মোবাইল ব্যবহারকারীদের জন্য। এরপর তা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের জন্য তৈরি ও সম্পাদনা করা হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ফিচার প্রায়ই ভিডিও কনটেন্ট হয়ে যায়। সেই বিশেষ সংবাদের চূড়ান্ত সংস্করণ অনেক চিন্তাভাবনা করে পরদিনের সংবাদপত্রে ছাপানোর জন্য তৈরি করতে হবে। তাই, একটি সংবাদই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের জন্য ভিন্ন ভিন্নভাবে তৈরি করতে হয়। এক হিসেবে কিছু ব্যাপার অনেক জটিল হয়ে গেছে। আবার আরেক হিসেবে প্রযুক্তি অনেক কিছু খুব সহজ করে দিয়েছে।
সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে অনলাইনে সংবাদ পড়ার জন্য অর্থ নিচ্ছে। একজন সাংবাদিক ও পাঠক হিসেবে আপনি এই পরিবর্তনকে কীভাবে দেখছেন?
ভালো কনটেন্টের জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে। এটা সোজা ব্যাপার। ভালো কনটেন্ট তৈরি করতে হলে অনেক কিছু লাগে। অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশে অধিকাংশ কনটেন্ট বিনা পয়সায় পড়া যায়।
অধিকাংশ সংবাদ প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সংবাদপত্র অর্থের বিনিময়ে সংবাদ, যাকে পে-ওয়াল মাধ্যমে বলা হয় সেই মডেলের দিকে যাচ্ছে। যদিও কিছু কনটেন্ট এখনো আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর প্রয়োজনে ফ্রি দেওয়া হয়, কিন্তু পাঠককে অর্থ ব্যয় করতে হবে। দুনিয়াজোড়া বিখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমসের মতো সংবাদপত্র এর অর্থনৈতিক মন্দার সময় সামলে উঠে অর্থের বিনিময়ে ডিজিটাল সংবাদ প্রদানের মডেল চালু করেছে। এই মডেলেই এখন তাদের সিংহভাগ আয় হয়। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাও একই কাজ করেছে। উভয় পত্রিকাই শুধু কনটেন্টে বৈচিত্র্য এনেই থামেনি, সেই সঙ্গে ব্যবসার মডেলে বৈচিত্র্য এনে ব্যবসার নতুন পথ উন্মোচন করেছে।
পরিবর্তনশীল কনটেন্টের উপস্থাপনের বৈচিত্র্যের বিবেচনায় আজকের সাংবাদিকের দক্ষতা আর সক্ষমতাও অনেক বেশি হওয়া চাই। প্রাথমিক সংবাদ কনটেন্ট তৈরি হতে হবে মোবাইল ব্যবহারকারীদের জন্য। এরপর তা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের জন্য তৈরি ও সম্পাদনা করা হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ফিচার প্রায়ই ভিডিও কনটেন্ট হয়ে যায়। সেই বিশেষ সংবাদের চূড়ান্ত সংস্করণ অনেক চিন্তাভাবনা করে পরদিনের সংবাদপত্রে ছাপানোর জন্য তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশের সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর এমন কোনো পথ বেছে নিতে হবে। আমাদের অডিও–ভিডিও ফরম্যাটে নতুন কনটেন্ট তৈরি করতে হবে। পাঠকদের কতটা ব্যয় করতে হবে, তা প্রধানত নির্ভর করবে কনটেন্ট তৈরির ব্যয়ের ওপর। প্রথম আলোর ই-পেপার আগে ফ্রি ছিল। কিন্তু খরচ দিন দিন বাড়ছে। ফলে আমরা বাধ্য হলাম ই-পেপারকে পে-ওয়ালের আওতায় নিতে। এটা থেকে খুব আয় হচ্ছে এমন নয়। কিন্তু ভাবনাটা হচ্ছে, কনটেন্টের জন্য ব্যয় করার ধারণার সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করানো। আমরা অনলাইনে প্রথমা.কম–এর মাধ্যমে বই বিক্রিও শুরু করেছি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ভুয়া খবর একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে এত ক্ষতি করছে, এ থেকে বাঁচার উপায় কী?
এই কাজ খুব কঠিন হবে। পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। দুনিয়ার যেকোনো জায়গা থেকে যে কেউ সহজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা ইচ্ছে ছড়িয়ে দিতে পারে। কোনো কিছু ছড়িয়ে দেওয়া এখন যে কারও হাতের মুঠোয়। যে কেউ নিজের মতো, ভাবনা বা ছবি ছড়িয়ে দিতে পারে। তাই আমার সন্দেহ হয় যে ভুয়া খবর বা গুজব ছড়ানো পুরোপুরি থামানো যাবে কি না। এ প্রেক্ষাপটে আমরা সাংবাদিকেরা কীভাবে কোনো সংবাদকে দেখি, এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আমাদের নিজ দায়িত্ব আরও সুচিন্তিতভাবে পালন করতে হবে। চারটি ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রচারণায় আমরা খুব উৎসাহিত হয়েছি। তারা একটি স্লোগান প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, ‘ছাপাই প্রমাণ’ ‘Print is proof’। এটা সত্য হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে সত্যগুলো উঁকি দিচ্ছে, সেগুলো অবজ্ঞা করার কোনো উপায় নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবকিছু অসত্য—এমন ভাবাটা ভুল।
প্রথম আলোতে আমরা সব সময় নৈতিক সাংবাদিকতা করি। কী ছাপা হবে, সে ব্যাপারে প্রথম আলো খুবই সতর্ক। কোনো ভুল তথ্য যেন ছাপা না হয়, সেই ব্যাপারে আমরা খুব সাবধান থাকি। আমরা বিশ্বাস করি, যদি আমরা পেশাদার সংবাদকর্মীরা যাচাই না করে প্রকাশিত সংবাদের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সজাগ থাকি, তাহলে সমাজে ও দেশে এর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে পারব।
সারা জীবনে আপনি অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বের সাহচর্যে এসেছেন। এঁদের মধ্যে আপনার মনে পড়লে ভালো লাগে, এমন কারও কথা বলুন।
ষাটের দশক, আমি তখন ছাত্ররাজনীতি আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সেই সময় এবং পরে দেশের বিদেশের বহু বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। অনেক প্রবন্ধ, বিশ্লেষণ আর মতামত লিখেছি। তবে সাক্ষাৎকার নিতে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ হয়েছে। প্রণব মুখার্জির সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনি তখন ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ক্রিকেট খেলোয়াড় পতৌদির নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি, মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর, অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী, অভিনেত্রী ও পরিচালক নন্দিতা দাস, গায়িকা রুনা লায়লা—এমন অনেকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
বিখ্যাত মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তবে একটি ঘটনা আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। নিশ্চয়ই আপনাদের শহীদ নূর হোসেনের কথা মনে আছে? তিনি ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বিক্ষোভের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছিলেন। সচিবালয়ের কাছে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর বুকে ছিল “স্বৈরাচার নিপাত যাক” আর পিঠে লেখা ছিল “গণতন্ত্র মুক্তি পাক”।
ডিসেম্বরের শেষের দিকে আমি বংশালের আমার একতা পত্রিকার অফিস থেকে সংসদ ভবন এলাকায় মণিপুরিপাড়ায় যাই শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে দেখা করতে। ওনাকে কিছু বই আর উপহার পৌঁছে দিতে। তিনি তখন ওই এলাকায় থাকতেন। একটি অটোরিকশা নিয়ে রওনা হই। সেটা নিয়েই ফিরি। কারওয়ান বাজার এলাকা পার হওয়ার সময় অটোরিকশার চালক জানতে চাইলেন, ‘স্যার, আপনি কি সাংবাদিক?’ আমি বললাম, কী করে বুঝলেন? উত্তরে তিনি বললেন, আন্দাজ করলাম। আরেকটু কথা বলতেই জানতে পারলাম তিনি শহীদ নূর হোসেনের বাবা। আমি একটি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম যেন! মাত্র কিছুদিন আগে নূর হোসেন নিহত হয়েছেন। সবাই তাঁর কথা জানে। সে ছিল এক অনন্যসাধারণ সাক্ষাৎ! তিনি যখন লারমিনি স্ট্রিটে আমার বাড়িতে আমাকে নামিয়ে দিতে গেলেন, আমি তাঁকে চা–নাশতা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালাম। চা খেতে খেতে কথা হলো। সে ছিল এক সুন্দর সম্পর্কের সূত্রপাত। তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, আমাদের ভালো যোগাযোগ ছিল। আমরা পারিবারিক বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হতো দুজনেরই বাসায় এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও। এখনো সেই পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। যেকোনো উপায়েই আমি এই পরিবারের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি।
আমি তাঁর বিষয়ে লিখেছি। সেই আকস্মিক সাক্ষাৎ, কিছু কথাবার্তা, সেই আবেগ আমার জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছে। পরবর্তী সময়ে কবি শামসুর রাহমান ও আমি নূর হোসেনের জীবন নিয়ে যৌথভাবে একটি বই প্রকাশ করি। শহীদ নূর হোসেন বইতে কবির লেখা তিনটি কবিতা আর আমার পাঁচটি লেখা ছিল।
এবার একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাক। দিনের প্রথম তিরিশ মিনিট আপনি কীভাবে কাটান? এত ব্যস্ততার মধ্যে দিনের এত কাজ কীভাবে সামলান?
আমার জীবন আবর্তিত হয় প্রথম আলোকে ঘিরে। ঘরে, পথে, অফিসে বা অফিসের বাইরে যেখানেই থাকি না কেন, আসলে আমি সব সময় প্রথম আলোকে নিয়েই থাকি। প্রথম আলো একটি বড় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন আমরা ২০–২৪ পৃষ্ঠার মূল সংবাদপত্র ছাড়াও ৮-১৬ পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র ছাপি। ক্রোড়পত্রগুলো বিভিন্ন বিষয়ের ফিচার আর্টিকেল থাকে। এসব সংবাদ ও ফিচার তৈরির পেছনে অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। এগুলো পরিকল্পনা আর সম্পাদনা করতে হয়, পড়তে হয়।
আপনি ৩০ মিনিটের কথা বলছেন, কিন্তু আমি যদি সকালের চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুধু এসবই পড়তে যাই, তাহলে ভাবুন কতটা সময় যায়! ৬০ মিনিট চলে যায় তো নিমেষে। তো এভাবেই আমার দিন শুরু হয়। অধিকাংশ সময় কিছু লেখা দেখার কাজ আমি বাড়ি নিয়ে আসি। সব মিলিয়ে সকালে আমার সারা দিনের প্রস্তুতি নিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। সময়টা নির্ভর করে সারা দিনে আমার কেমন কাজ আছে তার ওপর। সকালবেলাতেই সারা দিনের কাজের গতি ঠিক করতে হয়। তবে এত সবের মধ্যেও আমি কিছু খবর বা বই পড়া, কিছুটা গান শোনার সময় করে নিই। মনের খোরাক জোগানোও তো জরুরি।
সাংবাদিক আর পাঠকদের প্রতি আপনার কোনো বার্তা আছে?
একজন সংবাদপত্র পেশাজীবী হিসেবে, আমি শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সংবাদ আর সংবাদপত্রের মধ্যে বাস করি। তবে একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি এই জগতের বাইরেও অনেক কিছু আমার পছন্দ বা শখ আছে। বইপত্র পড়ার পাশাপাশি আমি গান ভালোবাসি, চিত্রকর্ম ভালোবাসি এবং সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। এগুলো আমাকে উদ্দীপ্ত করে, এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়। সবারই নিজের পছন্দমতো কিছু বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। তবে আমার পক্ষ থেকে অনুরোধ আছে, এই সবকিছুর মধ্যে আমাদের প্রত্যেকের আরও ভালো এক বাংলাদেশ, এক যথার্থ গণতান্ত্রিক আর আইনের শাসনে চলা দেশ গঠনের আশা রাখা উচিত, এর জন্য কাজ করা উচিত। আমার পাঠক ও বন্ধুদের কাছে অনুরোধ, এটা আমাদের দেশ আর তাই একে উন্নত, মানবিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমাদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত। আমার অনুরোধ, দেশের ভালোর জন্য আমরা যেন নিজেদের সবটুকু দিতে পারি। শুধু ক্রিকেটে নয়, সব ক্ষেত্রেই যেন বাংলাদেশ বিজয়ী হতে পারে।
প্রত্যেকের জীবনেই মা খুব বড় ভূমিকা রাখেন। বাবা ভূমিকা রাখলেও কোনো কারণে মায়ের কথাই প্রথমে এসে যায়। মায়ের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তবে যদি এমন কারও কথা জিজ্ঞাসা করা হয় যাকে আমি খুব উঁচু মাপের মানুষ মনে করি, যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজের আদর্শ নৈতিকতা গড়ে তোলা যায়, তাহলে আমার আদর্শ হচ্ছেন রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, সাংবাদিক এবং খুব বড়মাপের বুদ্ধিজীবী। মতাদর্শ ছিল বামপন্থা। তাঁর কাছ থেকে বহু কিছু শিখেছি, তাঁর কথা আমি প্রতিদিনই ভাবি। রণেশ দাশগুপ্তের একটা শিক্ষা আমি সব সময় মনে রাখি, মেনে চলি—বিনয়ী হও, নম্র হও আর মানুষের কথা শোনো। এ কথা বলে ফিরে আসতে চাই এই মহৎ মানুষটার আদর্শের কাছে—নম্র হও, মানুষকে সহায়তা করো আর বিনীত হও।
আরও পড়ুন
- পক্ষপাতমূলক সাংবাদিকতা কখনো সফলভাবে টিকে থাকতে পারে না
- সেনাশাসন আমাদের কাম্য নয়
- দেশের অগ্রগতির জন্য নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি জরুরি
- Vision Statement
- প্রিন্ট আর ডিজিটালের সমন্বয়ের মধ্যেই সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিহিত
- বাংলাদেশে সত্যিকারের রেনেসাঁর সময় হলো ষাটের দশক
- জনকল্যাণেও ভালো কাজ করছে গণমাধ্যম
- Predisposed journalism can never grow and sustain