তাঁদের কথা মনে রাখব
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি সুহৃদ-কবি-লেখক-শিল্পীরা নানাভাবে অবদান রেখেছেন। তাঁদের সহানুভূতি, সমর্থন ও সহযোগিতা সশস্ত্র লড়াইয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে, সাহস জুগিয়েছে। তাঁদের সেই অবদানের কথাই তুলে ধরা হয়েছে মতিউর রহমান সম্পাদিত ‘ভালোবাসায় বাড়ানো হাত’ বইয়ে। এই লেখাটি লেখকের কথা হিসেবে ‘তাঁদের কথা মনে রাখব’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
গত শতকের সেই পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে তত্কালীন পূর্ব বাংলায়—বাংলাদেশে বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন আর স্বাধিকারের সংগ্রামের শুরু থেকেই কবি, লেখক, শিল্পী, গায়ক বা অন্যান্য মাধ্যমের সব সংস্কৃতিসেবীর স্মরণীয় অবদানের কথা আমরা জানি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে, বিশেষ করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকেই দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনও একটি স্বতন্ত্র বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে, গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে সর্বস্তরের মানুষকে।
বাংলা ভাষা, বাংলা গান, কবিতা, শিল্পকলা, নাটক, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতিসহ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংস্কৃতিজগতের প্রায় সবাই নিজেদের যুক্ত করেছিলেন। পঞ্চাশের পর ষাটের দশকে কোনো কোনো সময়ে এ ধারা শুধু বেগবানই হয়নি, কখনো মুখ্য প্রভাবশালী ধারায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাঙালি-হৃদয়ের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী দিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ধারা শক্তিশালী হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুনীর চৌধুরীর (২৭ নভেম্বর ১৯২৫—১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) নাটক, শহীদুল্লা কায়সারের (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭—১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) উপন্যাস, আলতাফ মাহমুদের (২৩ ডিসেম্বর ১৯৩৩—১৯৭১) গান এবং জহির রায়হানের (১৯ আগস্ট ১৯৩৫— ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২) গল্প, উপন্যাস, সিনেমাসহ আরও অনেকের অবদানের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি।
সেই বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামের পর থেকে দীর্ঘ দুই দশকের অব্যাহত সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে দেশবাসী যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মরণপণ সশস্ত্র সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ, তখন আমাদের দেশের প্রায় সব লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবী এ লড়াইয়ের সঙ্গে শুধু সহমর্মিতা প্রকাশ করেই তাঁদের দায়িত্ব পালন শেষ করেননি, প্রত্যক্ষভাবে এ লড়াইয়ে অংশও নিয়েছেন। কবিতা, গান, নাটক, চিত্রকলা, সিনেমাসহ বিভিন্নভাবে দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ অথবা ক্যাম্প বা অন্যত্র সমবেত মানুষকে তাঁরা উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন। ওয়াহিদুল হক (১৬ মার্চ ১৯৩৩—২৭ জানুয়ারি ২০০৭) আর সন্জীদা খাতুনের (জন্ম: ৪ এপ্রিল ১৯৩৩) নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংগ্রামী শিল্পী দল শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে ও বিভিন্ন জমায়েতে গিয়ে গান করেছেন। কামরুল হাসানের (২ ডিসেম্বর ১৯২১—২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮) নেতৃত্বে শিল্পীরা এঁকেছেন ছবি, তৈরি করেছেন নানা পোস্টার। গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে জহির রায়হান তৈরি করেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্যের প্রামাণ্যচিত্র স্টপ জেনোসাইড। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে বাস করেও স্বাধীনতার জন্য গান তৈরি করেছেন আলতাফ মাহমুদ, কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান অথবা উপন্যাস রচিত হয়েছে আনোয়ার পাশা বা শহীদুল্লা কায়সারের ক্ষিপ্রহস্তে। বেগম সুফিয়া কামাল (২০ জুন ১৯১১—২০ নভেম্বর ১৯৯৯) অবরুদ্ধ ঢাকার প্রতিদিনের ডায়েরি লিখেছেন। ডায়েরি লিখেছেন জাহানারা ইমাম (৩ মে ১৯২৯—২৬ জুন ১৯৯৪)। স্বাধীনতার পর সেগুলো বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এভাবেই আমাদের দেশের সব সংস্কৃতিসেবী দেশের স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য উজ্জ্বল এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। আর এ জন্যই শুধু মুনীর চৌধুরী আর শহীদুল্লা কায়সার বা আলতাফ মাহমুদ নন, দেশের সেরা বুদ্ধিজীবী-লেখক ও অধ্যাপকদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সেনারা।
একাত্তরে দেশের অভ্যন্তরে বা সাহায্যকারী প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাংলাদেশের সাহসী সংস্কৃতিসেবীরা যখন তাঁদের সব শ্রম দিয়ে অনুপ্রেরণা সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছেন, তখন আমরা দেখি, আন্তর্জাতিক পরিসরেও দেশে দেশে বিশ্বনন্দিত শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি বা গায়কেরা একইভাবে আমাদের স্বাধীনতার সমর্থনে মহতী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা কবিতা পাঠ করে, কনসার্টে গান গেয়ে, ছবি এঁকে এবং সংহতি আন্দোলন গড়ে তুলে আমাদের মহাবিপর্যয়ের দিনগুলোতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সভা-সমাবেশ বা মিছিল করে নিজ নিজ দেশের মানুষের মধ্যে আমাদের জন্য সহানুভূতি সৃষ্টি আর সমর্থন আদায়ের জন্য দৃঢ় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক সংহতি আন্দোলনে তাঁরা বিশাল অবদান রেখেছেন। তাঁদের সেসব কবিতা ও গান শুনে, সে সময়ে তাঁদের আরও নানা ভূমিকার নতুন নতুন তথ্য পেয়ে আমাদের হৃদয় আজও উদ্বেল হয়, আমরা অনুপ্রাণিত হই। তাঁদের অনেক কথা হয়তো এখনো আমাদের অজানা। সেসব দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আরও অনেক সংস্কৃতিসেবীর অবদানের সব কথা কি আমরা আর কখনো জানতে পারব? আমরা জানি কেবল অল্প কজনের কথা। তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির যাঁদের কথা স্মরণ করতে হয়, তাঁরা হলেন আর্জেন্টিনার খ্যাতনামা লেখক ও রবীন্দ্র-অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, ফ্রান্সের প্রখ্যাত মানবতাবাদী সংগ্রামী লেখক আঁদ্রে মালরো, ভারতের পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ‘বিটলস’-এর গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও রিঙ্গো স্টার, নোবেল বিজয়ী কবি ও গায়ক বব ডিলান, মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, রুশ কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি, অস্কার বিজয়ী যুক্তরাজ্যের অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন, মার্কিন গায়িকা জোয়ান বায়েজ প্রমুখ।
প্রতিবেশী ভারতের সে সময়কার প্রায় সব ভাষার প্রায় সব শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীর ঐশ্বর্যমণ্ডিত ভূমিকা কি আমাদের পক্ষে কোনো দিন ভোলা সম্ভব? চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক সত্যজিৎ রায়, প্রয়াত গায়িকা লতা মঙ্গেশকর, লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি ও লেখক বিষ্ণু দে, লেখক মুলকরাজ আনন্দ, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, অভিনেতা রাজ কাপুর, গায়ক ও সুরকার শচীন দেববর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, ভূপেন হাজারিকা, সলিল চৌধুরী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কাইফি আজমি, লেখক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে সহমর্মিতা জানিয়েছেন, নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। সাধ্যমতো সবকিছুতেই তাঁরা অংশ নিয়েছেন। এখনো মনে পড়ে, একাত্তরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে বেরাইদ হয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে নৌকায় ভাইবোন আর মা-বাবাকে নিয়ে নানার বাড়ি কাপাসিয়া যাচ্ছি। হঠাৎ কলকাতা রেডিওতে বেজে উঠল দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে সেই দারুণ প্রণোদনাময় গান, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন, জ্বলে দ্বিগুণ দারুণ প্রতিশোধে...’। সে গানের কথা, সে গানের সুর এখনো বুকের ভেতর বাজে গভীরভাবে, শুনলে নতুন করে উদ্দীপ্ত হই।
কলকাতার রবীন্দ্রসদনে সুচিত্রা মিত্র গাইছেন ‘আমার সোনার বাংলা’ আর তাঁর দুই চোখ বেয়ে অবিরল ঝরছে অশ্রুধারা—উপস্থিত বন্ধু আবুল হাসনাতের কাছ থেকে শোনা এই দারুণ আবেগপূর্ণ দৃশ্যের কথা যখনই মনে হয়, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, তাঁকে শতবার অভিবাদন জানাই। সেই একাত্তরে পঞ্চাশোর্ধ্ব কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়—যেন টগবগে তরুণ—পদ্য-গদ্য লিখছেন, বক্তৃতা করছেন, সীমান্তে যাচ্ছেন এবং মুক্তাঞ্চলে ঢুকে পড়ছেন, আরও কত-কী না করছেন! সেসব দিনের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ কবি সুভাষের রিপোর্টাজ গ্রন্থ ওদের ক্ষমা নেই এখন কোথাও পাওয়া যায় না। জীবদ্দশায় তাঁর সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে, তিনি সেসব দিনের কথা বলতেন। আর বারবার বলতেন জহির রায়হানের কথা। সে দিনগুলোতে কলকাতার প্রায় সব লেখক-কবি-শিল্পী নানাভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন।
বিগত বছরগুলোয় কলকাতায় যেসব কবি বা শিল্পীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁরাও বলেছেন সে সময়ে তাঁদের কর্মকাণ্ডের কথা। একাত্তরের পুরো ৯ মাসই কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের সব কবি, লেখক ও শিল্পী বাংলাদেশের সপক্ষে বহুমুখী কাজ করেছেন। প্রথম সারির শিল্পী কে জি সুব্রামানিয়াম ও যোগেন চৌধুরী আমাদের একাত্তরের সংগ্রাম নিয়ে যে শিল্পকর্ম করেছিলেন, তা উপহার দিতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের কোনো জাতীয় সংগঠনকে। অনেক বছর আগে সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে মুক্তিযোদ্ধা বৈমানিক বন্ধু আলমগীর সাত্তারের এক লেখায় জেনেছিলাম, বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলচ্চিত্র ও সংগীতজগতের অনেক শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সেখানকার বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির দুই সহসভানেত্রী ছিলেন অভিনেত্রী ওয়াহিদা রেহমান ও শর্মিলা ঠাকুর। আরও খোঁজ করতে করতে জেনেছি, এই দুই অভিনেত্রীই শুধু নন, বোম্বের তারকাজগতের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সহায়তায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।
একাত্তরে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের সংহতি আন্দোলনের সামনে ছিলেন লেখক, শিল্পী ও ধর্মীয় নেতারা। একাত্তরের ১১ জুন তাঁদের একটি প্রতিনিধিদল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলেন। এই দাবিনামায় যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিজয়া’—আশি-ঊর্ধ্ব ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসসহ আর্জেন্টিনার সেরা লেখক ও শিল্পীদের অনেকে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বাংলাদেশের সমর্থনে রাজধানী বুয়েনস এইরেসের একটি মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন।
শুধু ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো নয়, বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময় গর্জে উঠেছিলেন প্রবল বিক্রমে, বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদানের প্রতীকী অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে এ দেশ ঘুরে গিয়েছিলেন মঁসিয়ে আঁদ্রে মালরো। সেই ঘোর অমানিশার দিনে তাঁর দুঃসাহসী কণ্ঠস্বর আমাদের বিপুল প্রেরণা জুগিয়েছিল।
একাত্তরে বাংলাদেশ নিয়ে গায়ক-শিল্পীদের সবচেয়ে বিশাল সংগঠিত আয়োজন ছিল নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১ আগস্টে অনুষ্ঠিত অবিস্মরণীয় সংগীত অনুষ্ঠানটি। এ অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বাংলাদেশের জনগণের সাহায্যে কিছু করার জন্য তিনি প্রথম যোগাযোগ করেন জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। হ্যারিসন এগিয়ে আসেন এবং উদ্যোগী হয়ে অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ৪০টি মাইক্রোফোনে অনুষ্ঠানের গান ও কথা রেকর্ড করে তিনটি লং প্লেয়িং নিয়ে একটি বড় অ্যালবাম প্রকাশ করা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল বহু রঙে মুদ্রিত সে অনুষ্ঠানের একটি সুদৃশ্য সচিত্র বই।
পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। বব ডিলানের সঙ্গে সে কনসার্টে গিটার বাজিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, বেজ গিটার লিওন রাসেল এবং টাম্বুরিন রিঙ্গো স্টার। এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, ডন প্রেস্টন প্রমুখ গান গেয়েছেন, গিটার বাজিয়েছেন। এ অনুষ্ঠানের জন্য জর্জ হ্যারিসন লিখেছিলেন নতুন গান—‘বাংলাদেশ’। গানটির কয়েকটি পঙিক্ত এমন:
এল একদিন বন্ধু আমার
চোখভরা তার ধু ধু হাহাকার
বলে গেল, চাই শুধু সহায়তা
দেশ তার আজ ধুঁকে ধুঁকে মরে
বেশি কিছু আমি জানতে চাই না।
এটি ছিল অনুষ্ঠানের শেষ গান। গিটার ও অন্যান্য আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত চড়া সুরের মধ্যে আর্তনাদের মতো করুণ অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জর্জ হ্যারিসনের এই গান আর তাঁর মহৎ উদ্যোগ আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে সংহতি প্রকাশের বহু স্মরণীয় কার্যক্রমের মধ্যে এক সমুজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।
নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সেদিনের সংগীত অনুষ্ঠানে যুদ্ধবিরোধী আর মানবতার আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে পরিচিত কণ্ঠশিল্পী জোয়ান বায়েজ অংশ নিতে পারেননি। সেদিন তাঁর অন্য একটি পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল বলে জানা যায়। ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরে যখন তুমুল বোমাবর্ষণ চলছিল, তখন সেখানে ছিলেন। শুধু ভিয়েতনাম নয়; লাওস, কম্বোডিয়া, ফিলিস্তিন, চিলি, আর্জেন্টিনা, চেকোস্লোভাকিয়াসহ বহু দেশে বন্দীমুক্তি, মানবাধিকার রক্ষা এবং যুদ্ধের বিরোধী অসংখ্য অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিদারুণ হত্যাযজ্ঞ তাঁর হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। জোয়ান লিখেছিলেন এক হৃদয় নিংড়ানো সংগীতালেখ্য। গানের শুরুর কয়েকটি লাইন এ রকম:
বাংলাদেশ...পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যায়
লক্ষ মানুষ নিহত হয় বাংলাদেশে
আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখি
ক্রুশবিদ্ধ পরিবার, কিশোরী মাতার অসহায় শূন্য দৃষ্টি
তার শিশু লড়াই করছে ঝড়-বৃষ্টি আর কলেরার সঙ্গে।
‘বাংলাদেশ’ গানটির গায়ক ও সুরকারও ছিলেন জোয়ান বায়েজ নিজেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই জোয়ান বায়েজের ‘বাংলাদেশ’ গানটি প্রথম শোনার সেই অভিভূত মুহূর্তগুলোর কথা এখনো স্মৃতিতে স্পষ্ট হয়ে আছে। সেই প্রথম শোনার পর এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ দশক ধরে বহুবার শুনলেও মনে হয় এই অবিস্মরণীয় গানটি আজও পুরোনো হয়নি। এখনো এ গান একাত্তরের সেদিনগুলোতে টেনে নিয়ে যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শোনা গানগুলোর মধ্যে জোয়ান বায়েজের গানটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে মনে করার কারণ রয়েছে। ‘প্রথম আলো’র অনেক অনুষ্ঠানে গানটি পরিবেশন করা হয়েছে।
বহুদিন ধরে জানতাম, ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর ইংল্যান্ডের স্যাডলারস ওয়েলস থিয়েটারে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অভিনেত্রী অস্কার বিজয়ী গ্লেন্ডা জ্যাকসন একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেছিলেন। এ অনুষ্ঠানের কথা অনেক আগে থেকে জানা থাকলেও সম্প্রতি ওই অনুষ্ঠানের আরও বিস্তারিত অনেক তথ্য পেয়েছি। লন্ডনের ওই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের দূরসম্পর্কের ভাইপো বীরেন্দ্রশঙ্কর। গ্লেন্ডা জ্যাকসন ছাড়াও এ অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ এবং লন্ডনের আরও অনেক লোকশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী ছিলেন। অবাক করা তথ্য হলো বাংলাদেশের দুজন লোকসংগীতশিল্পী মোশাদ আলী ও শাহ আলী সরকার সে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা গান করেছেন। অংশ নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী, গায়ক সবিতাব্রত দত্ত এবং আমাদের প্রিয় রুমা গুহঠাকুরতা প্রমুখ।
একাত্তরের ২০ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় নিউইয়র্কে সেন্ট জর্জ চার্চে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সে সময় দুই শিবিরে বিভক্ত বিশ্বের দুই প্রধান রাষ্ট্রের দুই কবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালেন গিন্সবার্গ ও রাশিয়ার আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি প্রথমবারের মতো একই মঞ্চ থেকে কবিতা পাঠ করেছিলেন। এ রকম একটি দৃশ্যের কথা ভাবলে এখনো শিহরণ জাগে আমাদের হৃদয়ে। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন কবি ও লেখক গ্রেগরি করসো, পিটার অরলভস্কি, কেনেথ কচ, এড স্যান্ডার্স প্রমুখ কবি। এই কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিল ‘আমেরিকানস ফর বাংলাদেশ’। সে সময়ে তারা বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও অর্থ সংগ্রহের কাজ করেছে।
বিট বংশের উদ্যোক্তা কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের লাখো-কোটি মানুষের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে ভারতে এসেছিলেন একাত্তরের সেপ্টেম্বরে। বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরের নিদারুণ অভিজ্ঞতা তিনি বাণীবদ্ধ করেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামের দীর্ঘ কবিতায়। এর একটি অংশ এ রকম:
লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার
উদর স্ফীত, বিস্ফারিত চোখের ধার
যশোর রোডে বিষণ্ন সব বাঁশের ঘর
ধুঁকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।
আমরা যখন মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘যশোর রোডে সেপ্টেম্বর’ গানটি শুনি, তখন সেদিনগুলোর দুঃখ-বেদনা-লড়াইয়ের কথা বড় বেশি মনে পড়ে।
এ ছাড়া সম্প্রতি ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন সূত্রে জানতে পারি যে ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্রিকেটের জন্য বিখ্যাত দ্য ওভাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত শরণার্থীদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের জন্য ‘গুডবাই সামার: কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি বিশাল রক কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্য আয়োজিত সেই রক কনসার্টে দর্শকসমাগম হয়েছিল ৩৫ হাজারের মতো। দ্য হু, দ্য ফেসেস, মট দ্য হুপল, লিন্ডিসফার্ন, কুইনটেসেন্স, অ্যাটমিক রুস্টার, আমেরিকা, দ্য গ্রিস ব্যান্ড ও কোচিসের মতো ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সেরা সব রক ব্যান্ড সেখানে গান পরিবেশন করে। পরে এ সম্পর্কে আরও অনেক কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য পেয়েছি।
এভাবে বাংলাদেশের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা কবি, শিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ অন্যান্য সৃজনশীল মানুষ। বাংলাদেশের মানুষের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁদের। আমাদের জীবনের সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে যাঁরা ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, শক্ত করে ধরেছিলেন আমাদের হাত, তাঁদের সবার কথা কি আমরা জানি? আমাদের লড়াইয়ের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন, আমাদের জন্য তাঁদের ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কি আমাদের কিছু করণীয় ছিল না?
কত দিন এ রকম ভেবেছি, বন্ধুরা আলোচনা করেছি, এসব মহৎ ও বিশ্বসেরা লেখক-শিল্পীকে যদি বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হতো, যদি তাঁদের নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে একটি অনুষ্ঠান করা যেত! সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের সামনে যদি তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া যেত! বহুদিন এ রকম একটি দৃশ্যের কথা ভেবেছি, স্বাধীনতার পর ঢাকা স্টেডিয়াম বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিশাল মঞ্চে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, লতা মঙ্গেশকর, বব ডিলান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জর্জ হ্যারিসন, অ্যালেন গিন্সবার্গ, সুচিত্রা মিত্র, ভূপেন হাজারিকা প্রমুখ উপস্থিত হয়ে কথা আর সুরের ঐশ্বর্যমণ্ডিত ভুবন রচনা করে তুলছেন। স্বপ্নের মতো হলেও এমন দৃশ্য কল্পনা করে বহুবার আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়েছি। তবে এ আবেগের কথা মনে রেখেই ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তিতে পণ্ডিত রবিশঙ্করকে ঢাকায় এনে বড় করে সংবর্ধনার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আসতে সম্মত হয়েছিলেন তিনি। সব ব্যবস্থাপনা প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন শিল্পী রবিশঙ্কর। ফলে আসতে পারলেন না আর। পরের বছর আবারও উদ্যোগ নিলাম; দিল্লি গিয়ে দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে। কথা দিলেন, সম্ভব হলেই আসবেন। কিন্তু আসতে পারলেন না তিনি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা দেশে কবি, লেখক ও শিল্পীদের বহুমুখী কার্যক্রম জানার চেষ্টা করেছি বহু বছর ধরেই। নানাভাবে নানা সূত্রে নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করেছি। শেষ পর্যন্ত সেসব সংগ্রহ একত্র করে আটটি লেখা তৈরি করেছি। বিগত বছরগুলোতে লেখাগুলো একাধিকবার তৈরি করেছি ও দেখেছি। সেগুলো সাপ্তাহিক ‘একতা’, দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’ ও ‘প্রথম আলো’তে বিভিন্ন সময়ে ছাপা হয়েছে। অনেকবার পুনর্লিখন করেছি।
বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংহতির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি স্বজন—কবি-লেখক-শিল্পীদের বহুমুখী অবদান বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁদের সহানুভূতি, তাঁদের ভালোবাসা বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী, কবি, অভিনেতা, সুরকার ও গায়ক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইকে অনুপ্রাণিত করেছে, সাহস জুগিয়েছে। তাঁদের কথা আমরা কোনো দিন ভুলব না। তাঁদের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ।