ঝড়ের পাখির অসমাপ্ত গান

আমাদের আলতাফ ভাই, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কথা মনে পড়ে না, এমন দিন যায় না। যেকোনো গান বা লড়াইয়ের কথা কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে হলেই তাঁর কথা ভাবি। আর তখনই মন বিষাদে ভরে যায়। তখন বারবার মনে ভিড় জমায় কত-না স্মৃতি, দূরস্মৃতি। ষাট দশকের সেই উত্তাল দিনগুলোতে আমাদের গানের, সংস্কৃতির, সংগ্রামের এক বড় প্রেরণা ছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। আর এটা ভেবে আরও কষ্ট পাই, আমরা সবাই মিলে তাঁকে কতটুকু মনে রেখেছি। আমাদের বহু ব্যর্থতার মধ্যে এ এক বড় ব্যর্থতা!

 

‘আমি এক খ্যাপা বাউল’

একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান একুশের মর্মবাণী, যাঁর সুরে যাঁর কণ্ঠে অমরত্ব লাভ করেছে, যা অনাদি ভবিষ্যতেও বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করবে, তিনি হলেন আমাদের আলতাফ ভাই, শহীদ আলতাফ মাহমুদ। তাঁর কণ্ঠে ছিল দুরন্ত এক ঝড়, খ্যাপা বুনো, যা জনসমুদ্রে তরঙ্গমালা সৃষ্টি করে আছড়ে পড়ত শ্রোতার মনের গহিন গভীরে। যাঁরা তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন, গান শুনেছেন, তাঁদের পক্ষে ‘আমি এক খ্যাপা বাউল’ গণশিল্পী আলতাফ মাহমুদকে ভোলা কি সম্ভব?

আলতাফ মাহমুদের গান প্রথম শুনেছি, সে কোন কালের কথা, ’৫৫ বা ’৫৬ সালে, আরমানিটোলা মাঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি/ ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’। এ গান তাঁর কণ্ঠে পেয়েছিল অনিন্দ্য এক মহান রূপ। পরে এ গান শুনেছি কাজী আনোয়ার হোসেন বা রথীন্দ্রনাথ রায়ের কণ্ঠে। কিন্তু আলতাফ মাহমুদের গলায় সে গান অতুলনীয়। একইভাবে বলা চলে, যে গানই তিনি গেয়েছেন একবার, তা অন্যের কণ্ঠে সে রকম আর হয়নি, তেমন ভালো লাগেনি। গানের কথা, সুর, উদাত্ত কণ্ঠ আর তাঁর মুদিত আঁখি মিলে যে পরিবেশ সৃষ্টি হতো, এমনটা আর কারও কাছ থেকে পাইনি। তেমন আর হয় না। মনে পড়ে, তিনি ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’ গানের একপর্যায়ে এসে চোখ বন্ধ, ঘাড় আর মাথার সঙ্গে সঙ্গে চুল ঝাঁকিয়ে ঝড় তুলে যখন একক কণ্ঠে গেয়ে উঠতেন ‘যখন প্রশ্ন ওঠে যুদ্ধ কি শান্তি’, তারপর সমবেত কণ্ঠে ‘শান্তি, শান্তি’ সে দৃশ্য, সে স্মৃতি কখনো মুছে যাবার নয়।

’৬৩ থেকে ’৬৯ সাল পর্যন্ত একুশের অনুষ্ঠানের রিহার্সাল বা অনুষ্ঠানে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি বারবার শুনে শুনে একবারও ক্লান্ত হইনি আমরা। আজও শুনে একইভাবে অনুপ্রাণিত হই। এই একটি গান, যাকে বলা যায় আমাদের শোনা সব গান, সব গণসংগীতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এ রকম একটি গানের সুর রচনার জন্যই একজন শিল্পী চিরদিনের জন্য অমর হয়ে থাকতে পারেন। বিগত পাঁচ-ছয় দশকের সব গান, সকল গণসংগীতের সেরা গান বললে কি খুব বেশি বলা হবে? শুধু একটি নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে প্রতিটি গানই তাঁর কণ্ঠে পেয়েছে এক অপূর্ব বাঙ্ময়তা। এমনকি, শিল্পী আবদুল লতিফ রচিত ও সুরারোপিত আরেকটি মহৎ গানও ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ নিঃসন্দেহে আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে অনেক বেশি সফল হয়েছিল।

১৯৬৭ সালে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত বিপ্লববার্ষিকীতে শহীদুল্লা কায়সার রচিত ‘আমি স্পার্টাকাস’ গানটি যখন গেয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ, তখন তিনি নিজেই যেন হয়ে গিয়েছিলেন দাস বিদ্রোহী নেতা স্পার্টাকাস। আর ১৯৬৭ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার যে নতুন সুর করেছিলেন, সে রকম অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল কি? সে কবিতার কথা আর সুরের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে আলতাফ মাহমুদও যেন মঞ্চে বিদ্রোহী হয়ে উঠতেন, শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে সে রকম পরিবেশই সৃষ্টি হতো। সে সময় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত ছায়ানটের নজরুলের গানের অনুষ্ঠানের জন্য এই গানটির নতুন সুর এটি তৈরি করেছিলেন। একক ও সমবেত কণ্ঠে গানটির পরিবেশনা এখনো খুব মনে পড়ে। একই অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের আরেকটি গান ‘আমি এক খ্যাপা বাউল’, সত্যি যেন সে জগতেই চলে গিয়েছিলেন তিনি। এই গানটির সুরও করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। পরে জাহেদুর রহীমের কণ্ঠেও শুনেছি গানটি।

১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীতেই কতগুলো গানের সুর করেন আলতাফ মাহমুদ, যেগুলো অমরত্ব লাভ করল। ভাষা আন্দোলন আর ভাষাশহীদদের উদ্দেশে নিবেদিত সেসব গানের সংগ্রামী প্রত্যয় আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। সে সময়েই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতার নতুন করে সুর দেন। আর সে গানটি প্রায় সাত দশক ধরে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে পতাকা হিসেবে সামনে রয়েছে। শোক, ঘৃণা, প্রতিরোধের আগুন রয়েছে সে গানের কথা আর সুরে। প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এ গান আমাদের হৃদয়-মনকে মথিত করে, ব্যথিত করে, আবার প্রতিবাদে প্রজ্বলিত করে।

 

সারা জীবনই আন্দোলনে-সংগ্রামে

আমরা জানি, ১৯৪৮ সাল থেকেই গণসংগীতের সঙ্গে আলতাফ মাহমুদের সংযোগ। তারপর এ জগৎ থেকে তিনি কখনোই সরে যাননি। পেশা হিসেবে নয়, একজন সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে গণশিল্পী আলতাফ মাহমুদ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র আর প্রগতির সংগ্রামের যেকোনো আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। ১৯৫০ সালে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই একনিষ্ঠ কর্মী, গায়ক ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী।

বরিশাল শহরের ফকিরবাড়ি রোডে ছিল আলতাফ মাহমুদের পিত্রালয়। সেখান থেকে ১৯৪৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। শৈশবকাল থেকে গান আর ছবি আঁকার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অল্প দিনের জন্য আইএসসিতে পড়াশোনা করেন। কিছুদিন কলকাতার আর্ট কলেজেও পড়াশোনা করেছিলেন। সে সময়েই বেহালাবাদন শিক্ষা শুরু করেন। তখনই গণসংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ দেখা যায়। ১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আসেন। তারপর থেকে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ঘাম, শ্রম, অর্ধাহার-অনাহার আর মনপ্রাণের সবকিছু দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে যে স্বাধীনতাসংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, সে মহান সংগ্রামেই রক্ত ঝরল তাঁর। তিনি শহীদ হলেন। কী মহান এই আত্মোত্সর্গ!

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে ’৫৫ বা ’৫৬ সালের শুরুতে করাচি যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি সারা বাংলাদেশে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, ছায়ানৃত্যে অংশ নিয়েছেন। এমনকি প্রয়োজনে নৃত্যেও অংশগ্রহণ করেছেন। আমরা জানতে পারি, সেদিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ, যুবলীগ, যুক্তফ্রন্টের মঞ্চ বা কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে। কোনো প্রাপ্তি নয়, মানুষকে সংঘবদ্ধ, অনুপ্রাণিত এবং সংগ্রামের মিছিলে শামিল করার লক্ষ্য থেকেই এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ।

’৫৫-এর শেষে বা ’৫৬ সালের শুরুতে কোনো এক সময়ে ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য করাচি পর্যন্ত গিয়ে আর যেতে পারেননি। পাকিস্তান সরকার তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে। তারপর কয়েক বছর, পাঁচ-ছয় বছর করাচিতেই থেকে যান আলতাফ মাহমুদ।

’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় আলতাফ মাহমুদ তাঁর পিতার বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানে অংশ নিয়েছেন, গান গেয়েছেন। তাঁর পিতা নাজেম আলী তাঁর পক্ষে মুলাদীতে গিয়ে ক্যানভাস করতে অনুরোধ করেছিলেন। এ রকম বিরল সংগ্রামী সততা আর সত্সাহস এখন কোথায়? এই নির্বাচনের সময় আলতাফ মাহমুদ বহু গানে সুর দিয়েছিলেন। সে গানগুলো সারা বাংলার মানুষের মনে দারুণ জোয়ার সৃষ্টি করেছিল। সেসব গান হারিয়ে গেছে।

’৫১ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, বেশির ভাগ সময় আলতাফ মাহমুদ এই সংগঠনের অফিস ৪৩/১ যোগীনগর লেনে (মোহাম্মদ তোয়াহার বাসভবন) থাকতেন। অর্থাভাব আর কষ্টকে নিত্যসঙ্গী করে তিনি মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন এই সংগঠন আর সংগ্রামের কাজে।

 

কাছ থেকে দেখা

গণশিল্পী আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল ১৯৬৪ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের রিহার্সাল ও প্রস্তুতিমূলক অন্যান্য কাজের মধ্য দিয়ে। ডাকসুর উদ্যোগে কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানটি সেবারই প্রথম হয়েছিল শহীদ মিনারে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। সে সময়ে ডাকসু নেতৃত্ব ছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের হাতে। সে সুযোগে তখন আমাদের সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মূল কর্মী সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের মূল সংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলেন। ধারাবর্ণনা লিখেছিলেন শিল্পী কামরুল হাসানের ভাই প্রয়াত অধ্যাপক বদরুল হাসান। আলতাফ মাহমুদ ছাড়া অন্যান্য শিল্পীর মধ্যে ছিলেন জাহেদুর রহীম, ফাহমিদা খাতুন, অজিত রায়, লায়লা মোজাম্মেল, মাহমুদা খাতুন প্রমুখ। আজ ভাবতে অবাক লাগে, সে সময়ের একজন সেরা শিল্পী জাহেদুর রহীম এই একুশের অনুষ্ঠানে শুধু সমবেত সংগীতে অংশ নিয়েছিলেন। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ফাহমিদা খাতুন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির একটি স্তবক—‘সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে/ রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;/ পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন’ গেয়েছিলেন একক কণ্ঠে। আর সেবারই প্রথম অজিত রায়ের কণ্ঠে আলতাফ মাহমুদ সে গান তুলে দিয়েছিলেন ‘বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা...।’ সেই তরুণ বয়সে অজিত রায়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠে সে গান শুনে আমাদের স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। একক ও সমবেত কণ্ঠেও এ গানটি পরিবেশিত হয়েছিল। ধারাবর্ণনায় অংশ নিয়েছিলেন বদরুল হাসান, কামাল লোহানী, কাজি মদিনা ও ডলি মনিরুজ্জামান (বাংলার অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের স্ত্রী)। আর দেশের সেরা যন্ত্রীদেরও সমবেত করা হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি সে সময়ে সর্বমহলে বিশেষ সাড়া জাগিয়েছিল।

অবশ্য ’৬৩ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনের পর, দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের গানের অনুষ্ঠানে হয়েছিল, তাতে আলতাফ মাহমুদসহ দেশের সেরা প্রায় সব গণশিল্পীই অংশ নিয়েছিলেন। সেটিই এযাবত্কাল অনুষ্ঠিত সব গণসংগীতের অনুষ্ঠানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা যায়। সেই অনুষ্ঠানে প্রথম আমরা আলতাফ মাহমুদকে দেখেছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে তিনি গেয়েছিলেন আবদুল লতিফের লেখা ও সুর দেওয়া গান ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’। এই অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন শেখ লুতফর রহমান, আবদুল লতিফ, সুখেন্দু চক্রবর্তী, জাহেদুর রহীম, ফাহমিদা খাতুন, মাহমুদা খাতুন, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী প্রমুখ।

’৬৪ সালের পর থেকে ’৬৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার মধ্য দিয়ে শিল্পী আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়েছিল। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি নয়, ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উপলক্ষে অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি সংসদ, সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি, কলেজ শিক্ষক সমিতি বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র হল সংসদের অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিয়েছেন। সেগুলোতে আবুল হাসনাতসহ অন্য সহযোগী বন্ধুরা আমরা একত্রে যুক্ত ছিলাম। উদ্দীপ্ত সে দিনগুলো, সে রাতগুলোর সব কর্মকাণ্ড আজও বড় বেশি পিছু টানে।

সে সময়ে প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে এলেই আমরা আলতাফ মাহমুদের শরণাপন্ন হতাম। এবং প্রায় শেষ সময়ে তাঁর কাছে যেতাম। এতে তিনি কিছুটা ক্ষুব্ধ হতেন। কেন সময় থাকতে আসি না, কেন এ রকম অল্প সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে একুশকে পালন করতে যাই, এখানেই তাঁর আপত্তি ছিল। তারপরও তিনি এসেছেন। রিহার্সালে ঠিক সময়মতো আসতেন। অন্যরা বিলম্বে। এতে কোনো কোনো দিন খুব অসন্তুষ্ট হতেন। তারপরও নতুন ছেলেমেয়ে বা অল্প গান-সুর জানাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করতেন। তবে খুব তৃপ্তি পেতেন না, সেটা বোঝা যেত। কিন্তু একুশের অনুষ্ঠানের আহ্বানকে কখনোই ঠেলে সরিয়ে দিতেন না। একুশের জন্য পেশাগত কাজের চাপ বা সময়াভাবের অজুহাত তাঁর ছিল না কখনোই। সেটা ছিল তাঁর জন্য এক অসম্ভব চিন্তা।

ছাত্র ইউনিয়ন ও সাংস্কৃতিক সংসদের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ’৬৬ সালের বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দুই সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনের গণসংগীতানুষ্ঠান আর আলতামাস আহমেদ পরিচালিত বিদ্রোহী নৃত্যনাট্যের পেছনে প্রচুর শ্রম দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তাঁর করা কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ গানের নতুন সুরও দারুণ হয়েছিল। সেদিনের অনুষ্ঠানের মঞ্চ নির্দেশনা ছিল শিল্পী নিতুন কুন্ডুর। আলতামাস আহমেদ ও আলতাফ মাহমুদ—এই দুজনকেই আমাদের অনুষ্ঠানের জন্য জহির রায়হান ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর চলচ্চিত্র বেহুলার কাজ চলছিল।

তবে এ সময়কালে (১৯৬৭ সাল) যে অনুষ্ঠানটির জন্য আলতাফ মাহমুদ সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছিলেন, সেটি ছিল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে পল্টন ময়দানে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানের ধারাবর্ণনা লিখেছিলেন শহীদুল্লা কায়সার। এই ধারাবর্ণনা পাঠ করেছিলেন অধ্যাপক সেলিনা বাহার জামান। প্রচণ্ড উত্সাহ নিয়ে আলতাফ মাহমুদ নতুন গানের সুর করেছেন, পুরোনো গানের রিহার্সাল করেছেন। এমনকি এ অনুষ্ঠানের জন্য তিনি নিজেও একটি গান লিখেছিলেন। ছায়ানৃত্যের পরিকল্পনা করেছেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটির প্রাণকেন্দ্র ছিলেন তিনি। আর এর মূল সংগঠক ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার। তাঁকে সহায়তা করেছে আবুল হাসনাত, সে সময়ের ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রধান কর্মী। তবে এ অনুষ্ঠানের পেছনেও ছিল সে সময়ের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগ।

ষাট দশকের শেষ দিকে কামাল লোহানীর নেতৃত্বাধীন ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী প্রভৃতি সংগঠনের অনুষ্ঠান করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। মনে পড়ে, সেই সময়েই বাফার হয়ে এনামুল হক রচিত হাজার তারের বীণার গীতিনাট্যের সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। আর আমরাও তখন ছাত্র আন্দোলন শেষে অন্য পথের যাত্রী হয়ে গেছি। আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ আর থাকেনি। কেন থাকেনি, এ কষ্ট আজও বড় বেশি করে বাজে।

 

অর্থকষ্ট ছিল, তবু...

একুশে বা অন্যান্য বড় অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তাঁর সাহায্য আমরা পেয়েছিলাম। এমনকি ’৬৫ সালে ঢাকা হল সংসদের অভিষেক (১ মে) অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন। পারিশ্রমিক বাবদ ৫০ টাকার সম্মানী দিয়েছিলাম। সে সময়ের অবস্থায় এ পরিমাণ অর্থ হয়তো তেমন কম ছিল না, কিন্তু আজকে সেদিনের কথা ভাবলে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। পরপরই ছিল ইকবাল হল ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শুরু হতে বিলম্বের কারণে শিল্পী আলতাফ মাহমুদ অসন্তুষ্ট মনে কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলেন। আমরা ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কিন্তু তার পরের দিন সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের অনুষ্ঠানে আবার ঠিক এসেছিলেন। সেদিন আর সাহস করে তেমন কোনো কথা বলতে পারিনি। সেই একই স্বল্প পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন সেদিনও।

এ সময়ে আলতাফ মাহমুদের বেশ অর্থাভাব ছিল। সে খবর অবশ্য আমাদের তেমন জানা ছিল না। তখন তিনি থাকতেন আজকের মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনে স্টেট ব্যাংক কলোনিতে তাঁর ভাইয়ের বাসায়। তাঁকে পেতে হলে যেতে হতো সকালে। কোনো কোনো সময়ে তাঁর খোঁজে বাসার ভেতরে না ঢুকে কিছুটা ভয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। জানতাম, ঠিক আটটার সময় তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসবেন। বের হয়ে এলে, সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে কথা বলতাম। সেখান থেকে তিনি যেতেন গোপীবাগের মোড়ের দেশবন্ধু খাবার দোকানে। পরোটা-ভাজি আর দই খেয়ে চলে যেতেন কোনো কাজে স্টুডিও বা অন্যত্র। এ রকম একদিন তিনি হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন তাঁর আর্থিক সমস্যার কথা। বলেছিলেন, ‘সামান্য আয়ের জন্য কোনো সিনেমায় গানের সঙ্গে আবহসংগীতে বেহালা বাজাই। গানের সুর করতে, রিহার্সালে গান শেখাতে গলায় রক্ত চলে আসে। তোমরা কি এসব বোঝো, জানো?’ মনে পড়ে, সেদিন তাঁর কথা শুনে যারপরনাই কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন আমাদের তো কিছু করার ছিল না। আমাদের প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানে তিনি আসবেন কি আসবেন না, কোনো সরাসরি হ্যাঁ বা না বলতেন না। বেবিট্যাক্সিতে ওঠার আগে শুনে নিতেন কোথায় ও কখন যেতে হবে। ঠিক সময়মতোই তিনি চলে আসতেন। আমাদের মনে আছে, তাঁকে দেখেছি, ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানে পেছনের সারিতে বসে শুধু বেহালা বাজাচ্ছেন।

১৯৬৯ সালের দিকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন হলে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সংস্কৃতি সংসদের নামে অর্থ সংগ্রহের জন্য অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল। সে অনুষ্ঠানে গান গেয়ে চলে যাওয়ার সময় সংগঠক আবুল হাসনাতের হাতে ৫০ টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। বলেছিলেন, ‘তোমাদের অনেক খরচ হলো।’ এ রকম মনের মানুষ, এ রকম বড় শিল্পী আজ কোথায়? আর এ রকম সংগ্রামী শিল্পী, সংস্কৃতিসেবীদের মেহনত ছাড়া কি কোনো দেশের মহান কর্মকাণ্ড সফল হতে পারে?

ষাট দশকের এসব বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে আলতাফ মাহমুদ সে সময় চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা নিয়েও ছিলেন ব্যস্ত। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সফল সংগীত পরিচালক।

 

মুক্তির সংগ্রামে শহীদ

একাত্তরে স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালে আলতাফ মাহমুদ অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতেই ছিলেন। গ্রামে তাঁর মা, ঢাকায় স্ত্রী সারা ও কন্যা শাওন এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের রেখে সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়ার কথা ভাবলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। নানা কারণেই হয়তো সম্ভব হয়নি। তবু ঠিক করেছিলেন, সেপ্টেম্বরে চলে যাবেন।

আলতাফ মাহমুদের প্রিয় শহর ঢাকায় তিনি কী করছিলেন? জানা যায়, এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনে তিনি গান লিখেছেন। আবদুল লতিফকে দিয়েও গান লিখিয়েছেন। দরজা বন্ধ করে গানে সুর দিয়েছেন। বাদ্যযন্ত্রী সংগ্রহ করেছেন। অত্যন্ত গোপনে, স্টুডিওতে সেগুলো রেকর্ড করেছেন টেপ স্পুলে। এ রকম একটি স্পুল নিয়ে একজন কুরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। পরেও নাকি আরও দুটো বড় স্পুল পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। এ সবকিছু কোথায় গেল?

অবরুদ্ধ ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। তিনি তাঁদের সাহায্য করতেন। এমনকি তাঁর বাসায় অস্ত্রভর্তি ট্রাঙ্ক লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ‘জনৈক মুক্তিযোদ্ধা’ এ তথ্য ফাঁস করে দিলে ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী আলতাফ মাহমুদকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। মাথা নিচু করে পা ওপরে ঝুলিয়ে বর্বর অত্যাচারের শিকার হন তিনি। তিনি কোনো কথা বলেননি। কারও কোনো কথা প্রকাশ করেননি। আর ফিরে আসেননি তিনি। তাঁর বৃদ্ধ মাতা ও তাঁর স্ত্রী থানা, জেল এবং হাসপাতালে ঘুরেছেন অনেক। ১৬ ডিসেম্বর এবং তারপরও তাঁরা খুঁজেছেন আলতাফ মাহমুদকে। আলতাফ মাহমুদ কোথাও নেই। আলতাফ মাহমুদকে কোথাও পাওয়া যায়নি। আলতাফ ভাই—আলতাফ মাহমুদ ছিলেন আমৃত্যু সংগ্রামী, লড়াইয়ের মাঠেই তাঁর মৃত্যু হলো। বর্বর পাকিস্তানি অত্যাচারী সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যা করেই শুধু তাঁর কণ্ঠ রোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত’—ঝড়ের পাখির অসমাপ্ত গানের কণ্ঠস্বর আজও বাজে আমাদের বুকের ভেতর। আজও তাঁর সুরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান গেয়ে হাজার-লক্ষ মানুষ মিছিল করে বাংলাদেশের সর্বত্র।