সেনাশাসন আমাদের কাম্য নয়
২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি এটিএন বাংলার বিশেষ অনুষ্ঠান ‘মিট দ্য প্রেস’ সরাসরি সম্প্রচারিত হয় চ্যানেলটির বসুন্ধরা স্টুডিও থেকে। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান। তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য প্যানেলে উপস্থিত ছিলেন বার্তা সংস্থা এপির ঢাকা ব্যুরো চিফ ফরিদ হোসেন এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বিশেষ প্রতিনিধি শফিকুল করিম। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন সাংবাদিক মনজুরুল আহসান। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে মতিউর রহমান দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা মত প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানের কথোপকথন হুবহু ছাপা হলো।
মনজুরুল আহসান: প্রিয় দর্শক, সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করছি এটিএন বাংলার বিশেষ অনুষ্ঠান ‘মিট দ্য প্রেস’। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে এটিএন বাংলার বসুন্ধরা স্টুডিও থেকে। আজ আপনাদের সামনে কথা বলবেন ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমান।
জনাব মতিউর রহমান, আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য উপস্থিত আছেন দুজন বিশিষ্ট সাংবাদিক—বার্তা সংস্থা এপির ঢাকা ব্যুরো চিফ ফরিদ হোসেন ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বিশেষ প্রতিনিধি শফিকুল করিম সাবু।
মতিউর রহমান, আমি আপনাকে একটি সহজ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে চাই। গত দুই মাসের মাথায় দেশে দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখলাম এবং তার পরও পরিস্থিতি স্থিতিশীল এ রকম বলা যাবে না। এ প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আপনি একটি সূচনা বক্তব্য দিন। এরপর আমরা প্যানেলের কাছে যাব।
মতিউর রহমান: আসলে এটা সত্যি যে আমরা বেশ একটা জটিল এবং কঠিন অবস্থার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম বা এখনো আছি—তা আমরা বলতে পারি। কারণ, আমরা দেখলাম, প্রথম যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে, সেটা কোনো কাজ করতে পারেনি, সেটা ব্যর্থ হয়েছে, ভেঙে গেছে সম্পূর্ণভাবে। নতুন আরেকটি সরকার হয়েছে। তাকে আপনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলবেন, না কি অন্য কোনো নাম দেওয়া হবে—এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এখনো সরকারটা পুরোপুরি গঠিত হয়নি। সে জন্য সরকারের গঠন, তার অবস্থান, তার ভূমিকা, ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু বলা বেশ কঠিন এখনো। আমার মনে হয়, আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে পরিষ্কার একটা চিত্র পাওয়ার জন্য।
শফিকুল করিম: আপনার এ সূচনা বক্তব্য থেকে আমার প্রথম প্রশ্ন, আপনি বলছেন যে সময় লাগবে এটা সম্পর্কে কিছু বলতে। কিন্তু পরের দিন যে লেখাটি লিখেছেন, সেখানে কিন্তু আপনি প্রথম দিনেই তাদের সমালোচনা করেছেন বলে আমার কাছে মনে হয়েছে এবং অনেক পাঠকের কাছে সেটা মনে হয়েছে। তাহলে আপনি সেটি করলেন কেন?
মতিউর রহমান: আমি এটি করলাম এ জন্য যে, ধরুন পাঁচ বছর একটা দল ক্ষমতায় ছিল এবং তাদের ক্ষমতায় থাকাকালীন অপশাসন, দুর্নীতি, ব্যর্থতা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেশবাসীকে একটা ভয়ঙ্কর জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম যে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে এ থেকে আমাদের কিছুটা সরিয়ে নেবে। একটু সামনের দিকে এগিয়ে দেখলাম যে নানামুখী চেষ্টা সত্ত্বেও এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিছু করতে পারল না বরং দিনের পর দিন এ সমস্যাটাকে বাড়িয়ে দিল এবং শেষ পর্যন্ত তা ভেঙে পড়ল। নতুন একটা সরকার গঠিত হলো। আমি আশা করি, নতুন সরকার যাঁরা হবেন, যাঁরা দায়িত্ব নেবেন, তাঁরা দেশের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে বুঝে নেবেন। কাজটা কঠিন-জটিল এবং একধরনের দুঃসাধ্য। সে জন্য এই প্রথম যে পাঁচজন নেওয়া হলো তার মধ্যে একাধিক ব্যক্তি সম্পর্কে আমি লিখেছি, সেটা নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে আমি তেমনভাবে খুব একটা উত্সাহিত হতে পারিনি।
আমি মনে করি, এটাকে আরও জোরালো ও শক্ত করতে, যাঁরা দেশ বোঝেন, জানেন, যাঁরা সত্যিকারের পথপ্রদর্শন করতে পারবেন, কাজ করতে পারবেন—এ রকম ব্যক্তি হলে আমি খুশি হতাম।
মনজুরুল আহসান: মতি ভাই, আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। সেটি হচ্ছে, আপনি একটি প্রেক্ষাপট বলেছেন যে ড. ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাজ করতে পারেনি, ব্যর্থ হয়েছে এবং যে সরকারটি গঠিত হলো সেই সরকারটিও এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করেনি। আপনি যদি আমাদের একটু পেছনে, একটু খোলাখুলি বলেন, আপনার কী মনে হয়, কেন অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যর্থ হলো?
মতিউর রহমান: একটা কথা প্রথমেই বলতে হবে যে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ খুব দুর্বল ব্যক্তি ছিলেন। এত বড় একটা সরকার পরিচালনা করা, একটা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় সমাধান করা, এগিয়ে যাওয়া এবং সবাইকে মিলিয়ে চলা, দেখা গেল যে তিনি এককভাবে সব কিছু করছেন। তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, এটা একটি রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা। অর্থাৎ তিনিই সব কিছু। এটা সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, যেটা আমরা পরিষ্কার দেখলাম, তাঁর পেছনে যে দল ছিল, আমি বলব যে বিএনপি এবং তার নেতৃত্ব সরাসরি প্রতিটি কাজে তাঁকে প্রভাবিত করেছে। তাদের ইঙ্গিতে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ চলেছেন। এই চলতে গিয়ে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সম্পূর্ণটাই গোলমাল করে ফেলেছেন।
ফরিদ হোসেন: জনাব মতিউর রহমান, আপনাকে আপনার রোববারের লেখাটার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েই আমি শুরু করছি। আপনার এই বিশ্লেষণ একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে বলে আমি মনে করি এবং অনেকে এটা নিয়ে আলোচনাও করছে। আপনার এ লেখাটির মধ্যে একটি কথা বলেছেন, যেটা অন্য অনেকেই লেখেনি। এটা হচ্ছে, এই যে পরিবর্তনটা হলো, নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলো, সেখানে সশস্ত্র বাহিনী একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমরা কিন্তু কোনো জায়গায়ই জানি না যে তাদের ভূমিকাটা কী? আপনি আরও লিখেছেন, দাতা দেশগুলোও একটা ভূমিকা পালন করেছে। আমি বিনীতভাবে আপনার কাছে জানতে চাই, আপনি কি বলবেন যে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাটা কী ছিল?
মতিউর রহমান: দেখুন, এটা আপনি, আমি এবং আমরা মোটামুটি সব জানি, বুঝি। ব্যাপারটা ছিল যে দুটি দল, দুটি জোট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ রকম জায়গায় পৌঁছেছিল যে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম, রক্ত, সংঘাত, গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থা সৃষ্টি করেছিল এবং এটা শুরু হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। এ অবস্থা পেছনে ফেলে দেশকে ফিরিয়ে আনার মতো শক্তি না আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে ছিল, না বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের ছিল। এ জায়গাতে কিছুটা রেফারির ভূমিকায় যদি আপনি আমাকে বলতে বলেন, অথবা এই সংঘাত থেকে দেশকে ফিরিয়ে আনা সম্পর্কে যদি আপনি আমাকে বলতে বলেন, এটার জন্য একমাত্র উপযুক্ত শক্তি দেশের মধ্যে ছিল, আছে—সশস্ত্র বাহিনী। আমার জানা মতে, তারা সরাসরি ভূমিকা নিয়েছে। তারা এ অবস্থার পরিবর্তন করেছে। তারা ইয়াজউদ্দিনকে পদত্যাগ করতে সহায়তা করেছে বা বাধ্য করেছে। দেশকে যে একটা স্বস্তির জায়গাতে নিয়ে আসা হলো এবং মানুষ যে একটা স্বাভাবিকতার মধ্যে ফিরে এসেছে তার পেছনে তাদের উদ্যোগ, চেষ্টা আছে বলে আমি মনে করি।
মনজুরুল আহসান: তা হলে কি এখানে এ কথা বলতে পারি যে আমাদের রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে এবং সে জায়গায় সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে?
মতিউর রহমান: আপাতত নিশ্চয়ই। আমাদের চোখের সামনে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। রাজনৈতিক দল, শক্তি, নেতৃত্ব—তারা দেশের পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারেনি। বরং তারা ক্রমশ একটা যুদ্ধ, একটা ধ্বংস, একটা বিভেদের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। তা থেকে ফিরিয়ে আনার মতো শক্তি রাজনৈতিক দল-গোষ্ঠীর মধ্যে ছিল না।
ফরিদ হোসেন: আমরা কি, এই যে বড় ঘটনাটি ঘটল বৃহস্পতিবার, এই বড় ভূমিকা রাখার বিষয়টা বললেন—অবশ্যই একটা বড় ভূমিকা রেখেছে—আপনি কি আপনার পাঠকদের জানাবেন, সেদিন আসলে কী ঘটেছিল বঙ্গভবনে?
মতিউর রহমান: সেটা একজন সংবাদপত্রকর্মী হিসেবে জানানো উচিত, যদিও আমরা বলব, পুরোটা আমরা জানি না। জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি যদি জানতে পারি, এটা অবশ্যই পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানো উচিত হবে। তবে এটুকু তো আমরা জানি যে সেনাবাহিনীসহ তিন প্রধান এবং অন্যান্য শক্তিশালী ব্রিগেড কমান্ডাররা গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করেন এবং তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেন, তাঁকে সাহায্য করেন এই পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে এবং বক্তৃতা দিতে ও জাতির উদ্দেশে জানাতে যে দেশে এ পরিস্থিতি চলতে পারে না। যে কথাটা অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন গত তিন মাস ধরে বলে আসছিলেন, আর সেদিন রাতে তিনি যা বললেন, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এবং আমি বলব যে দেশের মানুষের কথাই তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন শেষ পর্যন্ত।
শফিকুল করিম: তা হলে, জনাব মতিউর রহমান, আমরা কি প্রতিবারই আশা করব যে আমাদের রাজনীতি ব্যর্থ হবে এবং সামরিক বাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনী এসে আমাদের এখান থেকে উদ্ধার করবে?
মতিউর রহমান: আমি একটা কথা খুব পরিষ্কার বলতে চাই। আমি মনে করি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা অবশ্যই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত-পরিচালিত হতে হবে। এটাকে আমি একটা সাময়িক ব্যবস্থা বলব। স্বল্প সময়ের ব্যবস্থা, বাধ্য হয়ে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কেউ তো আজকে এখন পর্যন্ত এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলেননি। বলা সম্ভব নয়। এটা একটা বাস্তবতা। এটা একটা স্বীকৃত সত্য, সবাই এটা মেনে নিয়েছেন।
ফরিদ হোসেন: আমরা অনেক জিনিস দেখেছি, একসঙ্গে অনেক নাটকীয় ঘটনা। একটি হচ্ছে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলো হঠাৎ করেই, একটি হচ্ছে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেল, আরেকটি হচ্ছে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পদত্যাগ করলেন। এ ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটার পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সাধারণভাবে জরুরি অবস্থা যেটা হয়, এ ধরনের অবস্থা জনগণ তো বটেই কোনো সাংবাদিকেরও সাধারণত স্বাগত জানানোর কথা নয়। কারণ জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পরে আমরা যেটা দেখলাম যে বেসরকারি টেলিভিশনগুলো তাদের খবর প্রচার বন্ধ করে দিল এবং আপনি জানেন যে পত্রিকাগুলোতে ফোন এল, ‘আপনারা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বা এ ধরনের সমালোচনা করে কিছু লিখবেন না।’ তারপরও কেন আমরা, আপনার পত্রিকাসহ, দেখলাম যে এ জরুরি অবস্থা এবং পরিবর্তনটাকে স্বাগত জানানো হলো?
মতিউর রহমান: আপনি যদি বলেন, সরাসরি আমরা কোনো স্বাগত জানাইনি। বাস্তবতা এই ছিল, দেশ চলছিল না, দেশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। তা থেকে একটা স্বস্তিকর অবস্থায় ফিরে এসেছে। এ স্বস্তিকর অবস্থাকে অবশ্যই স্বাগত জানাই আমি। কারণ আমাদের স্কুল-কলেজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার, দোকানপাট সব খুলেছে। এগুলো তো মানুষ চায়। এগুলোকে জোর করে, বাধ্য করে, চাপ দিয়ে বন্ধ রাখার অবস্থা আমরা কখনোই গ্রহণ করব না।
ফরিদ হোসেন: আমি আপনার রোববারের লেখাটিতে আবার ফিরে আসি। এ লেখাটির মূল সুর যেটা আমি দেখেছি, আপনি বলেছেন যে বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক জোট বা দলগুলো যে আছে বা যে দুই নেত্রী আছেন তাঁরা বাংলাদেশকে চালাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। এখানে একটি সমালোচনা আছে যে আপনি দুটো দলকে একই পাল্লায় ফেলেছেন। আমি একটু ব্যাখ্যা দিতুে চাই এ জায়গায়। সেটা হচ্ছে, গত পাঁচ বছর বিএনপি ও জামায়াত জোট ক্ষমতায় ছিল এবং ১৪ দলীয় জোট, পরবর্তীকালে যা মহাজোট হয়েছে, তারা ক্ষমতার বাইরে ছিল। আজকে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেটা আপনারাও স্বাগত জানাচ্ছেন, আমরাও স্বাগত জানাচ্ছি। কীভাবে নির্বাচনটা বাতিল হয়েছে—একটা ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা করতে হবে, আইডি কার্ড করতে হবে, স্বচ্ছ ভোটবাক্স থাকতে হবে এবং নির্বাচন কমিশনে পুরো একটা সংস্কার করতে হবে। এ কাজটা যে হলো, আপনি কি মনে করেন, মহাজোট আন্দোলন না করলে এ পর্যায়ে আমরা পৌঁছাতে পারতাম?
মতিউর রহমান: খুব ভালো প্রশ্ন আপনার। আমি বলব যে, দেখেন, আমাদের ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি। দুটি দল দুবার ক্ষমতায় ছিল, দুবার বিরোধী দলে ছিল। আমি খুবই পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, তাদের কর্মকাণ্ড, পরিকল্পনা, রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা বা সংসদ বর্জন, সংসদে যাওয়া, হরতাল, অবরোধ, বয়কট ইত্যাদি করা, এগুলোর মধ্য দিয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ দল দুটির কাছ থেকে ভবিষ্যতের কল্যাণমুখী ভাবনা-চিন্তা, উদ্যোগ আমরা দেখতে পাইনি। আপনি যদি আমাকে এখন বলেন, সাম্প্রতিক অবস্থার জন্য দায়ী কারা, অবশ্যই বিএনপি সরকার—চারদলীয় জোট। তারাই পেছন থেকে ইয়াজউদ্দিনকে চালিয়েছে। তারাই চাবিকাঠি ঘুরিয়েছে। ঘুরিয়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করেছে, যার পক্ষে বিএনপি জোটেরও দাঁড়ানো আজ খুব কঠিন।
শফিকুল করিম: আমি আপনাকে একটা ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আপনার মনে আছে বোধ হয়, এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় আসার আগে আগে, সম্ভবত ১৯৮১ সালের গোড়ার দিকে তিনি একটা লেখা লিখেছিলেন। সাপ্তাহিক হলিডেতে ছাপা হয়েছিল। সেখানে কিন্তু তিনি সেনাবাহিনী আসবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ রকম কিছু কথা বলেছিলেন। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনার কথাতেও আমি এমন একটা ইঙ্গিত পাচ্ছি। আমি ছাড়াও যারা এটা নিয়ে আলোচনা করে সবাই কিন্তু বারবার এ কথাটায় আসছি। এ কারণে যে এই লেখাটি আপনি সবচেয়ে আগে লিখেছেন। যেদিন এটার বয়স ছিল মাত্র এক দিন, তখন আপনি লিখেছেন। আমি এ দুটির মধ্যে কিন্তু বেশ একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি। এটা কি পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনীকে আসার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন?
মতিউর রহমান: আমি বিগত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন বিষয়, ভালো-মন্দ মিলিয়ে সেনাবাহিনী সম্পর্কে অনেক লিখেছি। এটা আমার একটা বিশেষ বিষয় আপনি বলতে পারেন এবং আমি এটাও মনে করি যে, নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সেনাবাহিনী দেশের মানুষের একটি অংশ, খুবই বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেটাও আমার একটি বিবেচনা। দ্বিতীয় কথা হলো, আমি সব সময় এটা বলি যে, ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ভূমিকা, হত্যা, অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, নৃশংসতা সবকিছু হয়েছে। পরিষ্কারভাবে আমাদের এটা জানা আছে, এ কথাটা আমরা সব সময় বলি। কিন্তু ’৯০-এ এরশাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল শেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনীর একটা নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে। আমার জানা মতে, ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রস্তুতই হয়েছিল সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে। আপনারা জানেন যে ১৯৯৬ সালে দেশে একটা বড় সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। সেনাবাহিনী সেটা প্রতিরোধ করেছিল।
পরবর্তীকালে গত ১০ বছর যদি আমরা দেখি, রাষ্ট্রীয় কাজে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়, বিদ্যুকেন্দ্র রক্ষা, ট্রাফিক সিগন্যাল, ভিজিএফ কার্ড ইত্যাদি কাজ তারা করেছে। তারা যদি এ কাজগুলো করতে পারে, তো অন্য কাজ তারা করতে পারবে না কেন? আর এ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বা শান্তিরক্ষী বাহিনী আজকে সারা দুনিয়াতে দেশে দেশে নির্বাচন, গণতন্ত্র, অস্ত্র উদ্ধারের মতো কাজগুলো করছে। তারা সুনাম অর্জন করছে, তারা আমাদের জন্য বৈদেশিক অর্থ অর্জন করছে। এ কাজটি যদি তারা বিদেশে করে, যদি তারা আফ্রিকাতে করে, লাতিন আমেরিকাতে করে, তারা বাংলাদেশে করতে পারবে না কেন?
মনজুরুল আহসান: আমরা একটু দর্শক সারিতে যাই। দর্শক সারিতে প্রশ্ন নিতে চাই। তাঁরা কী বলেন বিষয়গুলোর ব্যাপারে।
দর্শক: মতিউর রহমান ভাইয়ের কাছে আমার একটি প্রশ্ন যে চারদলীয় ঐক্যজোট এবং মহাজোটের মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যে জোটই ক্ষমতায় আসুক না কেন, আমি মনে করি, আরেকটা জোট বিরোধিতা করবে। হরতাল, অবরোধ লেগেই থাকবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ মানুষের খুব ভোগান্তি হবে। সাধারণ মানুষ এ থেকে কীভাবে স্বস্তি ফিরে পেতে পারে?
মতিউর রহমান: যে কথাটায় আমার এ দুই বন্ধু বারবার প্রশ্ন উত্থাপন করলেন, আমি মনে করি, আজকে দেশের যে পরিস্থিতি, যে সংকট, যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এই সমস্যা, সংকট, অচলাবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করার মতো পরিস্থিতি উদ্ভব করার মতো শক্তি বর্তমান দুই রাজনৈতিক শক্তির নেই। তার মানে আমি এটা বলব না, যেটা ইতিমধ্যে আমার বন্ধু বলেছেন, আমরা দেশে সামরিক শাসন চাই না এবং সামরিক বাহিনীর দেশ পরিচালনা করা, রাষ্ট্র পরিচালনা করার দায়িত্ব তাদেরকে দেওয়া যাবে না।
মনজুরুল আহসান: তার যে প্রশ্ন তাতে তাঁর আশঙ্কা যে আবার জরুরি অবস্থা উঠে গেল, নির্বাচন হলো, তখন যারা পরাজিত হলো, তারা আবার একটি অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করবে। সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী?
মতিউর রহমান: একদম সঠিক বলেছেন আপনি। ইতিমধ্যে আমি আপনাকে বলতে পারি যে আওয়ামী লীগ উত্সাহের সঙ্গে বঙ্গভবনে গিয়েছে। বিএনপি যায়নি। শুধু যায়নিই না, তারা প্রবলভাবে উত্তেজিত যে তাদের সাজানো সংসার ভেঙে গেল। সর্বত্রই বাগান সাজানো ছিল এবং সেনাবাহিনীর ভেতরেও সেটা ছিল। ভেঙে গেছে, তারা ক্ষুব্ধ। নির্বাচনে যাবে কি না তারা নানা কথা বলে, তারা বলে যে যাব না।
দর্শক: জনাব মতিউর রহমান সাহেবের কাছে একটি বিষয় জানতে চাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ আগে আপনি একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, নতুন একটি সরকার গঠিত হয়েছে, তাকে আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলবেন, না কি অন্য কোনো সরকার বলবেন তার জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে। আসলে অন্য কোনো সরকার বলতে আপনি কি পরোক্ষভাবে সামরিক সরকারের কথা বোঝাতে চাইছেন? আমরা কিন্তু এখনো নিশ্চিন্ত নই যে বর্তমান দেশ চালাচ্ছে কে—তত্ত্বাবধায়ক সরকার, না কি সামরিক সরকার।
মতিউর রহমান: আমি খুব খোলামেলা বলি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালাচ্ছে, পেছনে অবশ্যই সেনাবাহিনীর সমর্থন আছে।
দর্শক: আমরা বিভিন্ন মিডিয়া থেকে শুনতে পাচ্ছি যে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনি কতটুকু জানেন? যদি ইয়াজউদ্দিন সাহেব পদত্যাগ করেন, জমিরউদ্দিন সরকার সাহেব আসবেন। এটা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটুকু মঙ্গলজনক হবে বলে আপনি মনে করেন?
মতিউর রহমান: খুব ভালো প্রশ্ন। কারণ দেখেন, এই যে সাজানো বাগান বললাম, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, বঙ্গভবন—সব সাজানো। আমি মনে করি, এটার সম্ভাবনা আছে। ইয়াজউদ্দিন দুর্বল হয়ে গেছেন। মানুষ তাঁকে গ্রহণ করে না। মানুষ তাঁকে চায় না। তিনি বিএনপির জন্য আর বিশেষ কিছু দিতে পারবেন না। সেখানে যদি আরেকজন নতুন, আরেকটু শক্তিশালী, আরেকটু প্রভাবশালী লোক আসেন তাহলে হয়তো বিএনপির কিছু সুবিধা হতে পারে। তারা ভাবতে পারে, তারা চেষ্টা করতে পারে। তখন তারা ইয়াজউদ্দিনকে বলবেন আপনি পদত্যাগ করেন। আমাদের আরও নিজস্ব ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিকে সেখানে দিয়ে দিই। এই সম্ভাবনাকে আমি নাকচ করি না।
মনজুরুল আহসান: আমরা দর্শক সারি থেকে একটি প্রশ্ন পেয়েছি। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে রাষ্ট্রপতির পদ থেকেও অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন সাহেব পদত্যাগ করবেন এবং জমিরউদ্দিন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। যদি আসলেই ঘটনাটি ঘটে, তাহলে কি একটা নতুন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে না? তার ফলে আপনি একটু আগে যে কথা বললেন, সেনাবাহিনী পেছন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সহায়তা করছে, তাদের এই সহায়তা কি এই পরিবর্তনের ফলে যে প্রত্যাশা সেই প্রত্যাশাটাকে ঠেলে দিয়ে আমাদের রক্ষা করতে পারবে?
মতিউর রহমান: আপনার প্রশ্নটা কঠিন, আবার সহজও এই অর্থে যে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাতে আমরা দেখি যে প্রতিরক্ষা বাহিনী রাষ্ট্রপতির অধীনে থাকে। রাষ্ট্রপতির অবস্থানটা এখানে খুব শক্তিশালী। ১৯৯৬ সালের ঘটনার সময় আমরা এটা দেখেছিলাম। সেদিক থেকে আজকে আমি বলতে চাই, সাজানো বাগানের যে কথাটি বললাম, সেনাবাহিনীও ওইভাবে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আজকে দেশের বাস্তব অবস্থার পরিস্থিতিতে একটা উদ্যোগ, একটা অবস্থান তারা নিতে বাধ্য হয়েছে। খুব যে উত্সাহের সঙ্গে খুশি হয়ে নিয়েছে সে সম্পর্কে আমি বলতে পারব না। কিন্তু এই উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হওয়াটা বোধ হয় এই সময়, এখন না হলে ভালো হয়। এদিক থেকে জমিরউদ্দিন সরকার একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রবীণ বিএনপি নেতা, আসলে সে রকম একটা চেষ্টা নিতে পারেন বলে আমার মনে হয় না। সেটা যদি নিশ্চয়ই বিএনপির নেতৃত্ব স্থির করে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সে কাজটা তারা করতে পারে।
মনজুরুল আহসান: প্যানেলের কাছে যাচ্ছি। আপনি লেখায় লিখেছেন যে, দাতা দেশগুলোর ভূমিকার কথাও আসছে।
ফরিদ হোসেন: আজকেই দেখলাম যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে না, জরুরি অবস্থা ঘোষণার পেছনে আমরা কোনো ভূমিকা পালন করিনি। তবে দেখেছি যে তারা সেই সময়টায় খুব দৌড়ঝাঁপ করেছে এবং বেশ কয়েকদিন যাবৎ করছিল তারা এবং ওই দিন বেশি করেছে। এই যে তারা বলছে যে আমরা কোনো ভূমিকা পালন করিনি এ ধরনের ক্ষেত্রে, সেটা কেন বলছে তারা?
মতিউর রহমান: দেখুন, এ বিষয়ে খুব পরিষ্কারভাবে ভেঙে আমার পক্ষে বলা কঠিন, তবে এটুকু বলতে পারি যে আমাদের দাতা দেশগুলোর ব্যাপারে তাদের অবস্থান, তাদের ভূমিকা, বর্তমানে দেশের ভেতর নানা কথাবার্তা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে। অনেকে পছন্দ করেন এবং অপছন্দ করেন। তবে আমি বলব, আমরা যে জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলাম, সেখানে জাতিসংঘ বলুন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ, এই দেশগুলোর প্রতিনিধি বা তাদের সরকারের অবস্থান আমাদের পরিস্থিতিকে কিছুটা সামলে উঠতে সহায়তা করেছে। এখন তারা কীভাবে সামলে দিয়েছে বলা কঠিন। কিন্তু আমি বলব, নিশ্চয়ই তারা একটা কথায় পরিষ্কার ছিল যে দেশে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেবে না, সামরিক শাসন জারি করা যাবে না, হত্যাকাণ্ড, রক্তপাত হবে না। শেষ পর্যন্ত এ রকম একটি সমাধানের কথা তারা বলে থাকতে পারে বা আপনারা শুনে থাকতে পারেন। যা-ই হোক, একটা শান্তিপূর্ণ ভালো অবস্থার পরিবর্তন এবং দেশটা যাতে আবার ফিরে নির্বাচনমুখী একটা গণতান্ত্রিক ধারায় যেতে পারে; সেই ক্ষেত্রে যদি তারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কোনো ভূমিকা নিয়ে থাকে, আমি এতে কোনো আপত্তি দেখি না।
শফিকুল করিম: আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই, সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে। আপনি বলেছেন যে এখানে একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই পরিবর্তন যেটা হয়েছে, তাতে তারা সহায়তা করেছে। আপনি যদি জাতিসংঘের যে স্টেটমেন্টটা ঢাকা থেকে দেওয়া হয়েছিল সেটা লক্ষ করেন; সেখানে লিখেছে ‘২২ জানুয়ারি নির্বাচনে আর্মি যদি সহায়তা করে, তাহলে তাদের শান্তিরক্ষার ব্যাপারে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। আমরা বিবেচনা করব তাদের নেব কি নেব না।’
এখন পেছন থেকে যদি তারা সরকার পরিচালনায় থাকে, যেটা আপনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাহলে শান্তি মিশনের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে কি না!
মতিউর রহমান: আমি বলব যে এটা খুবই সাময়িক ব্যবস্থা। একটা জরুরি আপদকালীন অবস্থায় তারা একটা ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করছে দেশকে একটি স্থিতিশীল একটা নির্বাচনমুখী ধারাতে নিয়ে আসার জন্য। এটার সঙ্গে সরকার পরিচালনা, সামরিক বাহিনীর দ্বারা সরকার নিয়ন্ত্রণ করা অথবা সামরিক সরকার—এ রকম আমি একদমই বলতে চাই না। বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর পক্ষে সেনাশাসন জারি করে দেশ পরিচালনা করা এটা সম্ভব নয়। এটা আমাদের কাম্যও নয়।
মনজুরুল আহসান: এখানে আমি দুটি সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। একটি সমস্যা হচ্ছে, যেটি ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর বারবারই বলা হচ্ছে যে ২২ জানুয়ারি বা ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে সংবিধান লঙ্ঘিত হয়ে যাবে, সংবিধান থাকবে না। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলছিলেন যে কে করবে? কারও কোনো উপায় নেই। কেউ কিছু করতে পারবে না। এখনো তো সংবিধান থাকল না। কাজেই একটা অসাংবিধানিক কাজে আমরা এলাম। আরেকটি হচ্ছে, আমরা বলছিলাম সারা দুনিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমরা মডেল হিসেবে করলাম, সেটিও ভেঙে খান খান হয়ে গেল। আমাদের সংবিধানও থাকল না, একটা মডেল প্রতিষ্ঠা করলাম সেটাও থাকল না, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোন জায়গায়?
মতিউর রহমান: ব্যাপারটি হলো, ঠিক যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম, সেটা থাকল না। বা, যে তারিখ নিয়ে আলোচনা করলাম, সেটাও থাকল না। কিন্তু আমাদের দেশ আছে, জনগণ আছে, ভবিষ্যৎ আছে। আমাদের তো একটি পথ বের করতে হবে। কথা আছে একটি নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে। আগামী নির্বাচন হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে এবং তার আইনগত সমাধান আমাদের আইন বিশেষজ্ঞদের বের করে আমাদের সামনে দিতে হবে। আমরা একটা জরুরি অবস্থার সময়ে আছি। এটা মানা ছাড়া আমাদের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।
মনজুরুল আহসান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতি কি আপনার মনে হয় শেষ হয়ে গেল?
মতিউর রহমান: আমার মনে একটি বিরাট প্রশ্ন জেগেছে যে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাটা আদৌ টিকবে কি না, চলবে কি না। কারণ যে কৌশলে এটাকে ধ্বংস করা হয়েছে, বিশেষ করে বিচারপতিদের মধ্য থেকে দলীয় লোকদের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়ে, এর মানমর্যাদা-সম্মান সেই ’৯৬ সাল বা ২০০১ সালের অবস্থায় আর নেই। এটাকে ফিরিয়ে আনতে গেলে এটার মধ্যে আরও বড় একটা জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন আছে। দেশের সকল দল, নাগরিক সমাজ, জনগণ বা সেনাবাহিনী মিলে এটা করতে হতে পারে।
মনজুরুল আহসান: আবার একটু দর্শকদের কাছে যাই।
দর্শক: আমি একটু ভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম। আমি ১৯৮৪ সাল থেকে আপনার লেখা পড়ি সাপ্তাহিক একতা থেকে। সব সময় একটা নিরপেক্ষতার মধ্য থেকে আপনি আপনার লেখা শুরু করেন এবং এভাবেই শেষ করেন। কিন্তু আমাদের দেশে যে বর্তমান বাস্তবতা চারদলীয় জোট এবং সম্প্রতি যারা বিরোধী দলে ছিল ১৪ দলীয় জোট, এই দুটির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে কি একটু দুই দলকেই এক করে ফেলা হচ্ছে না লেখার মধ্য দিয়ে? সেটা হচ্ছে যে মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই জায়গাটায় আপনার অবস্থান; আবার একই সঙ্গে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন—এ ব্যাপারগুলোকে কীভাবে দেখছেন?
মতিউর রহমান: আমি, আমরা আমাদের সময়ে যারা মানুষ, আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোকে স্মরণ করি। আমরা মনে করি, অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিকতা— এগুলো আমাদের মানুষের, দেশবাসীর অতি প্রিয় আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। কিন্তু গত ৩৫ বছর ধরে আমরা দেখছি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, শক্তিগুলো এই আদর্শ, এই লক্ষ্যকে ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে। সবশেষে আপনি যদি ১৪ দলীয় জোটের কথা বলেন, তারা যে মহা-ঐক্য গড়ে তুলেছে, তারা এরশাদের সঙ্গে যেভাবে লেনদেন করে সমঝোতা করেছে, যেভাবে শায়খুল হাদিসের দলকে তাদের সঙ্গে যুক্ত করেছে, তারপর তো আমাদের সেই আশার জায়গাটা আর থাকছে না। সেখানে তো আমরা বিভ্রান্ত, হতাশ, দুঃখিত, ব্যথিত। এখন আমাদের সামনে একটা নতুন কর্তব্য হয়তো আসছে। আমাদের নতুন করে এই গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রগতি—এ কথাগুলো নিয়ে ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে। নতুন শক্তির বিন্যাস, নতুন শক্তির ভিত্তি সৃষ্টি করতে হবে। যেটা আপনি বললেন, এই দুর্নীতি, এই চাঁদাবাজি, এই সন্ত্রাস—এসব কোন দলে নেই? কারা করে না? কীভাবে হয় না? গতকাল আমাদের কাগজে লিখেছি, আপনারা দেখেছেন—মনোনয়ন-বাণিজ্য, আজকে লিখেছি এরশাদকে নিয়ে বাণিজ্য। এ অবস্থার পরিণতিতে গিয়ে আমরা পৌঁছেছি। সেখানে নিরপেক্ষতা এটাই, সত্যিকার অর্থে দেশের মানুষ ও জনগণের কল্যাণের কথা আমাদের তুলে ধরতে হবে।
মনজুরুল আহসান: আমরা দর্শক সারি থেকে আরেকটা প্রশ্ন নেব।
দর্শক: আজকের ছাত্ররাই ভবিষ্যতে জাতির কর্ণধার হবে। কিন্তু আমাদের দেশে যে হারে রাজনৈতিক চর্চা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে কি কোনো ভদ্র পরিবারের সন্তান রাজনীতিতে যুক্ত হতে উত্সাহ পাবেন?
মতিউর রহমান: আমি একদম পরিষ্কার। আমি নিজে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম দীর্ঘ বছর, পুরো ষাটের দশক।
বর্তমানে যে অবস্থাতে এসে পৌঁছেছে ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র বন্ধুদের ও ছাত্রসমাজকে বলব এ ধরনের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত না হতে, এই ছাত্র আন্দোলন প্রত্যাখ্যান করতে। আমি সব সময় বলি, এ ধরনের ছাত্র আন্দোলন বন্ধ করে দিতে।
দর্শক: গত তিন-চার মাস ধরে আমি যা দেখলাম আমাদের সুশীল সমাজের অনুষ্ঠানগুলোতে, তারা কিন্তু খুব ভালো ভালো কথা বলছেন, নির্বাচন চাই, নিরপেক্ষ লোক চাই। আমরা সবাই জানি, এগুলো খুব বিষয়নির্ভর কথা। জিতলেই দেখা যায় সব ঠিক। মহিউদ্দিন যখন চট্টগ্রামে জিতলেন, তখন কিন্তু ভোটের কারচুপি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন যখন দেখা যাচ্ছে বিএনপি ক্ষমতায় নেই, এখন কমবেশি সবাই চলে গিয়েছে, তারপর আওয়ামী লীগ রাজি হয়েছে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত তাদের যতগুলো দাবি ছিল সেটা আসলেই কি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার জন্য, না কি তারা হিসাব করে ফেলেছে যে আমরা ১৫১ আসন পাব না বলেই আমরা নির্বাচন করব না। তাই আমাদের প্রথমে এ ব্যাপারটার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেন এবং পরে অন্য কিছু ভাবি যে আসলেই কি তা, না কি অন্য কিছু!
মতিউর রহমান: এ কথাটা আলোচনায় ছিল, বলতে পারেন আছে। যারা নির্বাচনে যাবে তাদের মধ্যে আলোচনাটা ছিল, বিব্রত ছিল। আমরা ১৫ বছর পরে একটা অবস্থায় পৌঁছে গেছি, যখন প্রধান দুটি দল বা জোট তারা কেউই পরাজিত হতে চায় না। উভয়কেই জিততে হবে। এটা সম্ভব নয়। কাউকে হারতে হবে, কাউকে জিততে হবে—এ অবস্থাটাও বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো মানতে চায় না এবং সেটাও আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।
শফিকুল করিম: আমি প্রশ্ন করছি যে আপনি নির্বাচনের কথা বলছেন। এখন দেখেন, গত নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২২ জানুয়ারি, সেটা মহাজোট বয়কট করেছে। আমরা যে নির্বাচনের কথা ভবিষ্যতে চিন্তা করছি, বঙ্গভবনে নতুন উপদেষ্টার শপথ অনুষ্ঠানে যাঁরা যাননি তাঁরা যদি সেটা আবার বয়কটের ডাক দেন, তখন এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখবেন?
মতিউর রহমান: বয়কটের ডাক দেবেন বলে ইতিমধ্যে তাঁরা ভাবতে শুরু করেছেন বলে আমি শুনেছি। তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না, তাঁরা বয়কট করবেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট উত্তেজনা আছে। আমি সেটাই বললাম যে আজকে রাজনৈতিক দলের নেতাদের যে অবস্থান, তাঁদের কাছ থেকে আমরা আশাবাদী হতে পারি না যে তাঁদের দিয়ে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন, সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থাৎ দেশের মানুষের কল্যাণকামী একটা ব্যবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।
ফরিদ হোসেন: আমার যে প্রশ্নটা, সেটা হচ্ছে যে আমরা কী চেয়েছিলাম আর কী পেলাম! নাকের বদলে নরুন। আমরা চেয়েছিলাম যে একটি সরকার পাঁচ বছর থাকার পর চলে যাবে এবং আরেকটি নির্বাচন হবে। আপনিও বলেছেন আপনার লেখায় যে আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে গণতন্ত্র এবং সেই গণতন্ত্রের লক্ষ্যে যাওয়ার জন্য আপনি বেশ কতগুলো এজেন্ডার কথা বলেছেন। কিছু কাজ করতে হবে, কিছু সংস্কার করতে হবে এবং আপনি এও বলেছেন যে এটা বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে সম্ভব নয়। নতুন যাঁরা উপদেষ্টা হয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন ‘আমরা জানি না যে আমরা তিন মাস থাকব না ছয় মাস থাকব, কতদিন থাকব আমরা জানি না, সেটা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে আমরা বলতে পারব।’ তাহলে কি আমরা একটা দীর্ঘস্থায়ী জরুরি অবস্থা এবং এই ধরনের একটা অনির্বাচিত সরকার দ্বারা দেশ শাসন ব্যবস্থায় পড়ে গেলাম? এবং আপনিও সেটাকে সমর্থন করছেন বা সেটার সঙ্গে একটা দল হয়ে যাচ্ছেন।
মতিউর রহমান: না। আমি সংবাদপত্রকর্মী হিসেবে কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত হওয়া, দল করা বা অংশ নেওয়ার প্রশ্ন আসে না। আমি বলব যে আমরা একটা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেছি। এটা আমরা সকলে স্বীকার করব। আজকে যদি আমাকে বলেন আপনি যে, তিন মাসের মধ্যে একটি ভোটার তালিকা হবে, একটা নির্বাচন হবে, সেটা আমরা গ্রহণ করব, গ্রহণ করে সরকার পাব— এটা আমার কাছে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। আজকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, কালো টাকার দৌরাত্ম্য, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতিবাজদের যে অবস্থান—এসব রেখে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক নির্বাচন সম্ভব নয়। তারপর আপনি যদি বলেন যে একটা ভালো শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, একটা সুষ্ঠু ভোটার তালিকা, একটা পরিচয়পত্র—এগুলো ছাড়া আপনি নির্বাচনে যেতেই পারেন না। এটা সম্ভবই নয়, এটা হবেই না। একই সঙ্গে আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। এই যে কাজগুলো, আমি মনে করি, এ কাজগুলো যথাসম্ভব পুরোপুরি হয়ে যাবে, একসঙ্গে হয়ে যাবে সেটা আমি বলি না। কিন্তু একটা পর্যায় পর্যন্ত হতে হবে। তখন আমরা মনে করব যে একটা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য এবং মোটামুটি স্বীকৃত হবে। এটুকু সময় হয়তো আমাদের দিতে হতে পারে। এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি কোনো উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলিনি, সেনাবাহিনীর কারও সঙ্গে আমার কথা হয়নি, এটা আমার সাধারণ ধারণা থেকে বললাম।
ফরিদ হোসেন: আপনার লেখাতে আপনি রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান নেতৃত্বকে ধোলাই করেছেন। বাস্তব চিত্রটি কিন্তু আমি ভিন্ন দেখি। এই যে আমরা সাংবাদিক, এই যে চিকিত্সক, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক—তাঁদের যতগুলো পেশাজীবী সংগঠন আছে তাঁদের দুটোরই কিন্তু ভাগ হচ্ছে কেউ শেখ হাসিনার, কেউ বেগম খালেদা জিয়ার। মাঝখানে কারও সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী, কারও সঙ্গে বামপন্থী দলগুলো আছে। এই অবস্থায় এটাকে যদি একটা পরিমাপ ধরি তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে, তাঁদের সঙ্গে তো দেশের জনগণ আছে। কিন্তু আপনার লেখায় স্পষ্ট হচ্ছে যে তাঁদের সঙ্গে কেউ নেই। মানে, আমি একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত সেখানে পাচ্ছি।
মতিউর রহমান: তাঁদের সঙ্গে কেউ নেই এটা খুব ভুল ব্যাখ্যা হবে। জনগণের একটা বড় অংশ দুই দলের সঙ্গে আছে। লাখ লাখ লোক তাদের মিছিলে জমায়েত হয়। যেকোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি লোক তাদের ভোট দেয়। তারা নিশ্চিতভাবে দেশের অত্যন্ত বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি। আবার এটা ঠিক, আপনি যেটা বললেন, কোনো পেশা, কোনো প্রতিষ্ঠান, কোনো জায়গা নেই যেখানে ভাগাভাগি নেই। এবং দেশের একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে যে রাজনৈতিক দলের বাইরেও যে আমরা নাগরিক সমাজ বলি, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, সাংবাদিক—সবাই বিভক্ত। একটা বড় প্রশ্ন আমাদের সামনে যে এ রকম একটা বিভক্ত সমাজ তো চলতে পারে না। এখন একে মেলাবে কে? সমবেত করবে কে? সমঝোতায় নিয়ে আসবে কে? শক্তি নেই, ব্যক্তি নেই। এভাবে সমস্যাগুলো আরও বড় হচ্ছে।
মনজুরুল আহসান: জনাব মতিউর রহমান, আপনারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হোক এ আন্দোলন করছেন। আপনারা প্রত্যাশা করছেন এবং বাইরে থেকে লোকজন বলছেও যে প্রচলিত ধারার রাজনীতির বাইরে রাজনীতি না করলেও আপনারা এক ধরনের রাজনীতি শুরু করেছেন। আপনার কি ধারণা এই সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আপনাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে?
মতিউর রহমান: আসলে আমরা তো অনেকটাই উত্সাহের সঙ্গে নেমেছিলাম, সারা দেশে ঘুরেছিলাম এবং সৎ ও যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন, আলোচনা, মানুষের জমায়েত, মতবিনিময়—খুবই উত্সাহিত হয়েছিলাম। কিন্তু সবশেষে দেখা গেল এই দুই রাজনৈতিক জোট এবং দলের কর্মকাণ্ড ও মনোনয়ন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পুরো জিনিসটাই প্রায় মাঠে মারা গেছে। অর্থাৎ এ বিষয়ে কারও কোনো আগ্রহ নেই। সে জন্য আমি বলব যে এ ধরনের আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ, সুশীল সমাজের উদ্যোগ, মানুষকে রাজনৈতিক সচেতন করা ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া—এ কাজগুলো আমাদের ভবিষ্যতে আরও বেশি করে করতে হবে। এ ছাড়া বোধ হয় আমাদের অন্য কোনো পথ নেই।
মনজুরুল আহসান: এর সঙ্গে আমি একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে চাই যে এ সরকারটি যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, লোকজন বলাবলি করছিল যে যারা সুশীল সমাজ, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর আবেদন করছে—তারা, বিদেশি কূটনীতিক, সেনাবাহিনী সবাই মিলে কাজটি করল। কতটা সত্যি!
মতিউর রহমান: এর সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ, কোনো ক্ষেত্রেই নেই।
ফরিদ হোসেন: আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে আপনি বললেন—আপনাদের এই কথার সূত্র থেকেই আমি ধরতে চাই যে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, ইত্যাদি হয়েছিল। একটা কথা বলা হচ্ছে যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা, যারা ক্ষমতায় যাচ্ছে। অনেকটা মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো। একবার এরা যাচ্ছে, আরেকবার অন্যরা ক্ষমতায় যাচ্ছে, কিন্তু তারা পারছে না। দেশের অবস্থা দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছে।
তাহলে পরে একটা তৃতীয় শক্তি হওয়া দরকার। রাজনৈতিকভাবে একটা তৃতীয় শক্তি বাংলাদেশে কেন গড়ে উঠছে না এবং এই তৃতীয় শক্তিটা কি গড়ে উঠছে না আপনার-আমার ব্যর্থতার কারণেই? জনগণের ব্যর্থতার কারণে! কী জিনিসটা এখানে বেশি কাজ করছে?
মতিউর রহমান: আমার কথা হলো, বিকল্প শক্তির একটা প্রয়োজনীয়তা আমাদের সমাজে এখন অবশ্যই দেখা দিয়েছে। সেটা কীভাবে, কখন কাকে কেন্দ্র করে, কোন গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে হবে তা বলা মুশকিল। তবে এটা নিশ্চয়ই যে একটা সময় নিয়ে মানুষকে সচেতন করে, অধিকার সচেতন করে, দাবি-দাওয়া নিয়ে একটা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে একটা কিছু আমাদের করার চেষ্টা করতে হবে। না করলে বর্তমান রাজনৈতিক শক্তি, দল, নেতৃত্বের কাছ থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
মনজুরুল আহসান: আমরা যতদূর জানি, এ সরকার এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি। কিন্তু এ সরকার নির্বাচনের জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এবং তার মধ্যে একটি উদ্যোগ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। কিন্তু যে নির্বাচন কমিশনকে একটি জোট প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আজকে যখন আলোচনায় সেই প্রসঙ্গটি এসেছে, মহাজোট কিন্তু বলেছে এই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তারা আলোচনায় বসবে না। কাজেই আমরা যদি দ্রুততম সময়ে একটি নির্বাচনের দিকে যেতে চাই, তাহলে কাজটি কোত্থেকে শুরু করা উচিত?
মতিউর রহমান: আমি বলব যে, অবশ্যই এই নির্বাচন কমিশনকে ভেঙে দ্রুত একজন বা দুজন নিয়ে শক্তিশালী, যোগ্য ব্যক্তিকে দিয়ে নির্বাচন কমিশন করা উচিত।
শফিকুল করিম: আপনি কি ভাবছেন যে এই নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য, যেটা বললেন যে যোগ্য, সৎ ও নিরপেক্ষ লোককে দিয়ে, এটা খুব তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হবে? এই যোগ্য লোককে বাছাই করা সম্ভব হবে সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে?
মতিউর রহমান: এটা একটু গোলমেলে। সব দলের গ্রহণযোগ্যতা আমার কাছে বড় নয়, সত্যিকার অর্থে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ড. ফখরুদ্দীনের সরকার যদি বলেন, তারা যদি একটা সত্যিকারের একজন সাহসী, দক্ষ ব্যক্তিকে দিয়ে নির্বাচন করায় তাহলে আমরা সবাই মেনে নেব। তিনি তাঁর কাজ দিয়ে প্রমাণ করবেন যে, তিনি একটি ভোটার তালিকা করতে পারেন, একটি নির্বাচন পরিচালনা করতে পারেন, তিনি একটি ভালো নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দিতে পারেন। আমরা গ্রহণ করব। রাজনৈতিক দলের কাছে দৌড়াদৌড়ি করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়। তাদের সুনির্দিষ্ট কাজ, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য আছে। তাদের কাজের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হবে তারা দক্ষ, যোগ্য এবং নিরপেক্ষ কি না। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সরকার, বিচারপতি লতিফুর রহমানের সরকার নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। তাদের তো এমন দৌড়াদৌড়ি করতে হয়নি।
মনজুরুল আহসান: এখানে আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুন্দরভাবে একটি নির্বাচন পরিচালনা করবে, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর মনোনয়ন দেবে দলগুলো, কিন্তু দলগুলোর তালিকা ইতিমধ্যে আমাদের সামনে চলে এসেছে। এবং সে তালিকাই আপনাকে সম্ভবত হতাশ করেছে। সে অর্থে নির্বাচনটি খুব ভালো হলো, কিন্তু যাঁদের মনোনয়ন দিলেন তাঁদের তালিকা আপনাকে হতাশ করল। তাহলে সেই সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর স্বপ্নটার বাস্তবতা আমরা কোথায় খুঁজে পাব?
মতিউর রহমান: সে জন্যই তো কথা বারবার চলে যায়, বললেই একটা বিপদে পড়ে যাব। সে জন্যই আমার মনে হয় যে আমাদের কিছু সময় নেওয়া ভালো। না হলে এর থেকে আমরা বের হতে পারব না।
দর্শক: জনাব মতিউর রহমান, একটি ভালো নির্বাচন হয়ে গেলে তার পরে আমাদের দেশে একটি সুন্দর অবস্থা বিরাজ করবে—এ কথা আমরা কেউ বলতে পারছি না। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও যদি সহিংসতা বিরাজ করে বা তার আভাস আমরা আগে থেকেই পেয়ে থাকি—সে মুহূর্তে আমাদের কী করণীয়? আমরা কি পারি না দুটি জোট—চারদলীয় ঐক্যজোট কিংবা মহাজোটকে একত্রে এনে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে আগামী পাঁচ বছর, ১০ বছর, বা তিন বছর বা দুই বছর নিশ্চিন্তে কীভাবে থাকতে পারি এ ব্যবস্থা নিতে। এ ব্যাপারে আপনারা যাঁরা নাগরিক আন্দোলন করছেন তাঁরা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবেন কি না? পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা বারবার ব্যর্থ হচ্ছি এবং এ মুহূর্তে যে জরুরি অবস্থায় আছি সেটা একটা সাময়িক অবস্থা, এটির সময় খুব কম। সাংবিধানিকভাবে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই এটির স্বীকৃতি নিতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে এখন এ অবস্থায় আমাদের এ মুহূর্তে কী করণীয়?
মতিউর রহমান: আপনার প্রথম প্রশ্নটি হলো, গত ২০ বছর ধরে বাংলাদেশের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। আপনার মনে আছে, কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান এখানে এক মাসের বেশি সময় ধরে ছিলেন। আপনার মনে আছে যে, আরও বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিছু হয়নি। আমি মনে করি, আজকে আমরা যেখানে গিয়ে পৌঁছেছি এই দুই দল বা জোটকে সমঝোতায় নিয়ে আসা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
দর্শক: বিভিন্ন মিডিয়া এবং সুশীল সমাজ সবাই বলছে যে, কালো টাকার মালিক যারা তাদের মনোনয়ন দেওয়া বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত নয়। আমার প্রশ্ন হলো, কালো টাকার মালিক কারা? যদি আমরা জানি যে আমাদের দেশে কালো টাকার মালিক আছে, তাহলে এ ব্যাপারে কোনো তালিকা আপনার পত্রিকা থেকে প্রকাশ করেন না কেন?
মতিউর রহমান: আমি আপনার এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ সমর্থন করি। আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যেকোনো সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যান— তাঁদের কাছে দাবি জানাই, এটা তাঁদের দায়িত্ব। তাঁরা এই কালো তালিকা আমাদের কাছে জানিয়ে দিন, কারা কালো টাকাকে সাদা করে, কোন এমপি-মন্ত্রীরা টাকার হিসাব দেন না, কোন মন্ত্রী-এমপিরা ট্যাক্স দেন না—এ হিসাব দেখা সরকারের দায়িত্ব। আমরা চেষ্টা করি। কিছু করি, কিছু পারি না। এ চেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে।
দর্শক: আওয়ামী লীগ শায়খুল হাদিসের সঙ্গে যে চুক্তিটা করেছে, সেই চুক্তিতে আমাদের কোনো দলের বিশেষ করে বাম দলগুলোর কোনো নেতাই কোনো প্রতিবাদ করেননি। সে ক্ষেত্রে আমরা যারা চিন্তাশীল চেতনা লালন করি বা চিন্তা করি, আমরা কোথায় যাব? আপনি একটি প্রশ্নের উত্তরে বলছেন যে, সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজ আছে। আমরা কি নিশ্চিত যে সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজ ভবিষ্যতে কোনো জোটে যাবে না?
মতিউর রহমান: আপনি যে কথাটা বলেছেন আওয়ামী লীগ এবং খেলাফত মজলিস যে চুক্তি করেছে এর জন্য ১৪ দলের অভ্যন্তরে বাম দলগুলো প্রতিবাদ করেছে, নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ প্রতিবাদ করেছে, আমরা সাংবাদিকেরা বিভিন্নভাবে কথা বলেছি। মিটিং, মিছিল, জমায়েত ইত্যাদি হয়েছে। এ প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে। আমি মনে করি, সুশীল সমাজ, নাগরিক সমাজ, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক—আমাদের কোনো রাজনৈতিক দলে যাওয়া উচিত নয়।
দর্শক: আমি গতকালকের ‘প্রথম আলো’তে মনোনয়ন-বাণিজ্য নিয়ে একটা লেখা দেখেছি। এই মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিষয়টি আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক দিন ধরেই। গতবার বিএনপিকে এটা প্রকাশ্যে বলা হয়েছিল। এবার বলা হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগেরটা প্রকাশ্যে, বিএনপিরটা পেছনে বলা হয়েছে। এই মনোনয়ন-বাণিজ্য আমরা কীভাবে দূর করতে পারি এবং কীভাবে এটা প্রতিকার করে আমরা ভালো ও যোগ্য প্রার্থী পেতে পারি। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। আপনারও ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো ইচ্ছা আছে কি না?
মতিউর রহমান: আমি একসময় রাজনীতি করতাম। আগামীতে কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক দল করব না, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ হওয়া জরুরি দরকার। প্রত্যেকটি দলের ভেতর এ ব্যাপারে প্রতিবাদ হওয়া উচিত। আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত। এটা বন্ধ না করলে কোনো সুষ্ঠু ও ভালো নির্বাচন হতে পারে না।
দর্শক: স্বাভাবিকভাবে সবাই ভাবেন, সেনাবাহিনী অনেকটাই বিএনপি-ঘেঁষা। এই ভাবকেন্দ্র পরিবর্তনের কারণটা কী? ছাত্রদের ব্যাপারে আপনি যেটা বলেছেন যে ছাত্ররাজনীতির দরকার নেই, কিন্তু আমরা শামসুন্নাহার হলে একটা আন্দোলন দেখেছি। তো ছাত্রদের ব্যাপারে আপনি কি কনসেপ্টটা একটু পরিষ্কার করবেন? কেন আপনি এটা বলছেন?
মতিউর রহমান: শামসুন্নাহার হলের আন্দোলনে ব্যাপক ছাত্রছাত্রী অংশ নিয়েছিল। কোনো বিশেষ দল, গোষ্ঠী বা সংগঠনের আন্দোলন ছিল না। আমরাও সেই আন্দোলনের সমর্থন করেছি। এ ধরনের যেকোনো আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করব। সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগ-বিএনপির নয়। যে সমস্যাটা আমাদের এখানে দেখা যায়, যখন একটা সরকার পরিবর্তন হয়, যারা সরকার গঠন করেন তারা চান যে শক্তি, সংগঠন, সংস্থার ওপরে তাদের প্রভাববলয় সৃষ্টি করে রাখতে, তাদের পছন্দমতো লোকগুলোকে নিয়ে আসতে। কেউ সেটা পারেন—পারেন না। এটা দিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো কাজ হয় না।
দর্শক: আমি মুহাম্মদ জসিমউদ্দিন। কালকিনির পৌর কমিশনার। আমি একটা বিষয় বলতে চাই, এম এ আজিজ সাহেব তিন মাসের ছুটিতে গিয়েছিলেন। তিন মাস তো শেষ হয়ে এল। উনি যদি আবার আসেন নির্বাচন কমিশনে, তখন দেশে কি স্বস্তি থাকবে, না আগের মতো হবে?
মতিউর রহমান: এম এ আজিজকে নিয়ে দেশে কোনো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এম এ আজিজকে যেতে হবে। সে জায়গায় নতুন কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করতে হবে।
দর্শক: আপনার কাছে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি সম্পূর্ণ জোর দিয়ে বলছিলেন যে, রাজনীতিবিদেরা ব্যর্থ। সেনাবাহিনী মোটামুটি সফল। তাহলে আমরা আপনার কথা থেকে কি এই ইঙ্গিত পাচ্ছি যে, আমরা সম্ভাব্য একটি সামরিক সরকার গঠন করতে যাচ্ছি।
মতিউর রহমান: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যন্ত যে আমাদের সাফল্য, তার পেছনে অবশ্যই রাজনৈতিক দল-নেতৃত্বের বিরাট ভূমিকা আছে। সাম্প্রতিক সময়ের ভূমিকাটা আমরা দেখি বিতর্কিত-সমালোচিত, এখনকার জন্য বর্তমানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে আর অগ্রসর হয়ে সামনে যাওয়া কঠিন। তার মানে এই নয় যে, সেনাবাহিনী, সামরিক শাসন এসে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে, আমাদের সবকিছু সহজ করে দেবে।
শফিকুল করিম: এ অবস্থায় আপনি কি একজন আশাবাদী, না নিরাশাবাদী?
মতিউর রহমান: আমার অবস্থান এখন মিশ্র। আশাবাদী, কিছুটা নিরাশাবাদীও। কিন্তু আশার দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, সামনে যেতে হবে, চেষ্টা করতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে, সাংবাদিক হিসেবে আমাকে ভূমিকা পালন করতে হবে।
শফিকুল করিম: এতক্ষণ যা আলোচনা হলো, আপনি কিন্তু বারবার নিরাশার কথাই বলেছেন আমাদের কাছে।
মতিউর রহমান: ওই যে বললাম, আশার সঙ্গে নিরাশা। নিরাশা আছে, আশাও আছে। না হলে বেঁচে থাকব কীভাবে? কাজ করব কীভাবে? এগোব কীভাবে?
ফরিদ হোসেন: আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যদি আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি, তাহলে আমাদের রাজনৈতিক দল থাকতেই হবে। বাইরের শক্তি দিয়ে সেই রাজনৈতিক দলকে সরিয়ে গণতন্ত্র করা যাবে না। আপনি কি মনে করেন যে এটা সম্ভব? বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কার করে তাদেরই আবার, যে জিনিসটা জনগণ চাচ্ছে, এদিকে আনা সম্ভব?
মতিউর রহমান: এখন দলগুলোকে ভেতর থেকে সংস্কার করা একটু কঠিন। কিন্তু আমাদের চেষ্টা রাখতে হবে। যদি না পারি, ব্যর্থ হয়ই, তাহলে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে নতুন কোনো শক্তি, নতুন কোনো দলের মধ্য দিয়েই পূর্ণ নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। এটা আমি মনে করি।
মনজুরুল আহসান: আমাদের অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন যদি আমি বলি যে, আমরা যত আলোচনাই করি না কেন সামরিক বাহিনী একটি বাস্তবতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি বাস্তবতা, চারদলীয় জোট একটি বাস্তবতা, মহাজোট একটি বাস্তবতা। এ চারটি বাস্তবতাকে সামনে রেখে রাজনৈতিক শক্তিগুলো চাচ্ছে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। এটা কত দ্রুত, কীভাবে, কত সুন্দরভাবে করা সম্ভব?
মতিউর রহমান: একটা মহাসংকটের একটা মহাসমাধান প্রয়োজন আমাদের। সে সমাধানে রাজনৈতিক শক্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন এবং সামরিক বাহিনী—সবাইকে মিলেই পথটা খুঁজতে হবে। তবে কতটুকু সময় লাগবে এটা বলা কঠিন। খুব দ্রুতও সম্ভব নয়, আবার বিরাট লম্বা সময় দেওয়াও ঠিক নয়। এবং আমি মনে করি, যত দ্রুত করতে পারি আমাদের জন্য তত ভালো। কিন্তু একটা কথা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা, কালো টাকা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য বন্ধ করা এবং ভালো শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন করা, ভালো ভোটার তালিকা করা—এগুলো জরুরি। এগুলো ছাড়া নির্বাচনে গিয়ে কোনো সমাধান হবে না।
মনজুরুল আহসান: ধন্যবাদ জনাব মতিউর রহমান, আমাদের এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য। শফিকুল করিম, জনাব ফরিদ হোসেন, আপনাদেরও ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন
- পক্ষপাতমূলক সাংবাদিকতা কখনো সফলভাবে টিকে থাকতে পারে না
- সেনাশাসন আমাদের কাম্য নয়
- দেশের অগ্রগতির জন্য নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি জরুরি
- Vision Statement
- প্রিন্ট আর ডিজিটালের সমন্বয়ের মধ্যেই সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিহিত
- বাংলাদেশে সত্যিকারের রেনেসাঁর সময় হলো ষাটের দশক
- জনকল্যাণেও ভালো কাজ করছে গণমাধ্যম
- Predisposed journalism can never grow and sustain