জীবন ও ভাবনা: সাংবাদিকতা

সাংবাদিকতা শুরু

আসলে আমি সাংবাদিকতার জীবনে হঠাৎ করে এসেছি। এখন বুঝতে পারছি যে আমাকে সাংবাদিকই হতে হতো। রাজনীতিও করেছি। রাজনৈতিক জীবন হবে আমার। এটাই ছিল সিদ্ধান্ত। তবে কীভাবে করব, সেটা পরিষ্কার ছিল না। হঠাৎ ১৯৭০ সালে, আমাদের কমিউনিস্ট পার্টি তখন গোপন পার্টি, গোপন পরিচয়ে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি পেয়ে গেল। সাপ্তাহিক একতা—অনেকেই নাম জানেন। আমি একতার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হয়ে গেলাম। আমি কিছুই জানি না। পরে সম্পাদক হয়ে ’৭০, ৮০, ৯০ দশকের শুরুতেও—১৯৯১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আমি সেই পত্রিকার সঙ্গে ছিলাম। আমি সরাসরি রাজনীতি করেছি ৩০ বছর। ২০ বছর সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক ছিলাম। কমিউনিস্ট পার্টির কাগজ একতার সাংবাদিক—সাংবাদিকতাতে তেমন একটা স্বীকৃতি ছিল না। আশির দশকের শেষের দিক থেকে অনেক পরিশ্রম করে দৈনিক সংবাদ-এ প্রতিবেদন লিখতাম, উপসম্পাদকীয় লিখতাম। আরও একাধিক সাপ্তাহিক কাগজে লিখেছি। বড় বড় সাক্ষাৎকার নিতাম।

আমি শেষবার মস্কোয় গিয়েছিলাম ১৯৮৮ সালে। মিখাইল গর্বাচেভের সময়। তখন সেই বিশাল ওলটপালট তর্ক–বিতর্ক সোভিয়েত ইউনিয়নজুড়ে। ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রাইকার’ বিশাল প্রভাব ও প্রচার। সে সময়ের পরিবর্তন নিয়ে বই লিখেছিলাম, খোলা হাওয়া খোলা মন। সেবার মস্কো গিয়েই আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘বাঁধাধরা’ এই ব্যবস্থা টিকতে পারে না। টিকছে না। তাই নিজের ভবিষ্যতের জন্য বিকল্প পথের সন্ধানের জন্য শেষ তিন–চার বছর অনেক পরিশ্রম করেছি। একতা করেছি ও সংবাদ-এ কাজ করেছি। আরও অন্য অনেক কিছু করেছি নিজের কাজের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য। সেই ধারাবাহিকতার প্রচেষ্টারই ফল ভোরের কাগজ এবং পরে প্রথম আলো

সাংবাদিকতার অর্জন

প্রথম আলো যখন শুরু করি, তখনো একটা ভালো বড় দৈনিক কাগজ করার কোনো অভিজ্ঞতা বা ধারণা আমার ছিল না। প্রথম আলো শুরু করতে গিয়ে আমার ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়েছিল। রক্তচাপও বেড়ে যায়। আমার ওজন কমে গিয়েছিল। ভয়ে কথা বলতে পারতাম না। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতাম না। হাসতে পারতাম না ভয়ে-আতঙ্কে। কী হবে, কী হবে!

আমাদের সেই সময়ের বন্ধুদের নিয়ে প্রথম আলোতে কাজ করেছি। এখনো চলছে অব্যাহতভাবে। কীভাবে আরও ভালো করা যায়, আরও ভালো করা সম্ভব, সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আরও চেষ্টা করতে থাকব। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৯ সালের আজ পর্যন্ত দিনে ১৪ ঘণ্টা বা ১৬ ঘণ্টা করে সাংবাদিকতা করি। পত্রিকাকে জীবনের সঙ্গে জড়াজড়ি করে আমরা বেঁচে আছি, টিকে আছি। আমাদের যুদ্ধ আছে, লড়াই আছে, চাপ আছে, ভয় আছে, ভুল আছে, ভালো আছে, অনেক সুনামও হয়েছে। আমার এক বন্ধু বলেছেন, ‘নিন্দিত সম্পাদক—আবার নন্দিতও বটে।’

সাক্ষাৎকার নেয়ার আগ্রহ

প্রতিবেদন, উপসম্পাদকীয় বা অনেক মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছি—সরাসরি শক্তভাবে, দলনিরপেক্ষভাবে। কেউ পছন্দ করুন না করুন, আমার মত প্রকাশ করেছি। আমার এই সব কাজের মধ্য দিয়ে বিরাট আগ্রহ তৈরি হয়েছিল মানুষের সঙ্গে কথা বলার। তাঁদের অনেকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগও পেয়েছি। সব সময় আমি অপেক্ষায় থাকি, কখন কার সাক্ষাৎকার নেওয়া যায়। যাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাঁরা হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, জোহরা তাজউদ্দীন, ফজলে হাসান আবেদ, রেহমান সোবহান, সন্তু লারমা, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব জে এন দীক্ষিত, জ্যেষ্ঠ আইসিএস পুলিশ কর্মকর্তা ভেদ মারওয়া, যিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে ঢাকায় একই বিমানে বাংলাদেশে এসেছিলেন; ভারতে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল—সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ’৭৫–এর ১৫ আগস্ট তাঁর অবস্থান ছিল সবচেয়ে বলিষ্ঠ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীর, বামপন্থী লেখক রণেশ দাশগুপ্ত, ভারতের অভিনয়শিল্পী সাইফ আলী খানের বাবা ক্রিকেটার নবাব মনসুর আলি খান পতৌদি, রুনা লায়লা, নন্দিতা দাসসহ আরও অনেকের। সাক্ষাৎকার নেওয়ার এই কাজগুলো করেছি ভালোবাসা থেকে, আগ্রহ থেকে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট এই ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারগুলো নিয়ে ইতিহাসের সত্যসন্ধানে: বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি নামে বই প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে করি, মানুষের সঙ্গে কথা বললে, আলোচনা করলে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়। ওহ, আমি আরেকটি সাক্ষাৎকার নিলাম চিত্রনায়িকা কবরীর। আমাদের খুব ভালো বন্ধু। তাঁর বন্ধুদের নিয়ে, তাঁর বন্ধুত্ব নিয়ে, তিনি কী মনে করেন, তিনি কী চান, কী রকম বন্ধু চান, কে তাঁর বন্ধু হতে পারে—এসব নিয়ে।

প্রথম আলো সফল কেন?

প্রথম আলোর মধ্য দিয়ে দেখতে পাই বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের সকল দেশ ও অঞ্চলে পৌঁছে গেছেন। আর তাঁরা যে যেখানে থাকুন না কেন, প্রতিদিন বাংলাদেশের সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকছেন গভীর ভালোবাসা নিয়ে। একই সঙ্গে আমরা তাঁদের প্রতিদিনের জীবনের সকল ভালো-মন্দ আর আনন্দ-বেদনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছি। জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী পাওয়ার আছে?

আবার এটাও সত্য যে প্রথম আলোর স্বাধীন ভূমিকার জন্য অনেক গালমন্দ শুনি। আমরা চাপে থাকি। মামলা-মোকদ্দমায় হাজিরা দিতে জেলায় জেলায় যেতে হয়। আবার অনেক সম্মান আর স্বীকৃতিও পাই মানুষের কাছ থেকে। পুরস্কারও পাই। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? একজন ‘অর্ধশিক্ষিত’ মানুষ হয়েও এর চেয়ে বেশি আর কী চাই এক জীবনে?

আমাদের প্রথম আলোর এই সাফল্য কেন? কারণ, ১. প্রথম আলো স্বাধীনভাবে সাহস নিয়ে চলে; ২. প্রথম আলো সততার সঙ্গে পরিশ্রম করে; আর ৩. প্রথম আলো বিনীত থাকে তার পাঠকদের কাছে, মানুষের কাছে। আমরা কাগজ করতে গিয়ে রোজ দেশে ও দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের মানুষের, তরুণদের, নারীদের নানা উদ্যোগ আর সাফল্যের খবর পাই। সেই সব খবর আমরা আপনাদের কাছে যখন পৌঁছে দিই, তখন কিন্তু নিজেরাও অনুপ্রাণিত হই। আমাদের এই জীবনের সকল ব্যর্থতা-সফলতার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বারবার বলি, গভীর ভালোবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে বলি, বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। আজ বিশ্বজুড়ে প্রবল পরিবর্তনের ঝড়। বিজ্ঞান আর তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সেই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করছে। বাংলাদেশের মানুষ অদম্য সৃজনশীলতায় তার ভালোটুকু আহরণ করছে।

'প্রিন্ট ইজ প্রুফ'

ছাপা পত্রিকা মরে যাচ্ছে— এমন অভিধার পক্ষে আমি নই। আমি আগেও বলেছি যে সংবাদপত্রশিল্প নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। আমরাসহ সারা বিশ্বের প্রকাশক, সম্পাদক আর সাংবাদিকেরা নতুন নতুন কনটেন্ট সংযুক্ত করে একে প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আরও বেশি মানুষের কাছে যাতে এর চাহিদা বাড়ে, তার জন্য কনটেন্ট, প্রতিবেদন, ফিচার, কলাম আর লেখার ধরনের মান বাড়াতে হচ্ছে। সমকালীনতাকে ধারণ করে পাঠকদের আমাদের সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে। পাঠককে শুধু সংবাদ দিলে আর চলবে না। সেই সঙ্গে অবশ্যই মতামত আর বিশ্লেষণ দিতে হবে। পাঠকের সংখ্যা যাতে না কমে, সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু বাস্তবে দুনিয়াজুড়েই প্রিন্ট মিডিয়ায় একটা ভাটার টান শুরু হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাবলম্বী থেকে প্রিন্ট মিডিয়াকে প্রাসঙ্গিক রাখতে আমরা বহু প্রতিকূলতার মোকাবিলা করছি। সবশেষে বলব, প্রিন্ট মিডিয়া প্রাসঙ্গিক থাকবে, কারণ ‘ছাপাই প্রমাণ’।

দুনিয়ার যেকোনো জায়গা থেকে যে কেউ সহজেই যে কোন তথ্য বা সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা ইচ্ছে ছড়িয়ে দিতে পারে। কোনো কিছু ছড়িয়ে দেওয়া এখন যে কারও হাতের মুঠোয়। যে কেউ নিজের মতো, ভাবনা বা ছবি ছড়িয়ে দিতে পারে। তাই আমার সন্দেহ হয় যে ভুয়া খবর বা গুজব ছড়ানো পুরোপুরি থামানো যাবে কি না। এ প্রেক্ষাপটে আমরা সাংবাদিকেরা কীভাবে কোনো সংবাদকে দেখি, এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আমাদের নিজ দায়িত্ব আরও সুচিন্তিতভাবে পালন করতে হবে। চারটি ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রচারণায় আমরা খুব উৎসাহিত হয়েছি। তারা একটি স্লোগান কাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, ‘ছাপাই প্রমাণ’ অর্থাৎ  ‘Print is proof’।

সাংবাদিকতার সামনে সমস্যা

পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে সাংবাদিকতার সামনে বাধা আসে না। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমার মনে পড়ে, ১৯৭৫ সালে একতাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে আবার ছাপা শুরু হয়। এরশাদ সরকার আবার তা দুই বছরের জন্য বন্ধ করে দেয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার ভোরের কাগজে সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। আমরা তখন রাজপথে নেমেছিলাম। শেষে সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ২০০০ সালে প্রথম আলো একই পরিস্থিতিতে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আবার সেই অবস্থায় পড়ি আমরা। ফলে দেখতেই পাচ্ছেন যে বিগত বছরগুলোতে আমরা অনেকবার এমন অবস্থার মুখে পড়েছি। এমনকি এখনো আমার সহকর্মী আর আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মামলা চলছে। এ জন্য আমাদের কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। প্রায়ই আমাদের একরকম ভয় আর অনিশ্চয়তায় মধ্য দিয়ে চলতে হয়। এর মধ্যে দেশের বড় কোম্পানী ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় যেন আমাদের বিজ্ঞাপন না দেয়। এ রকম সব চ্যালেঞ্জ আমাদের নিয়মিত সামলাতে হয়। তবে এসব আমাদের কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিতে হয়। এত সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমাদের যা করা উচিত বলে ঠিক করেছি, তা করে যেতে হবে। আর তা করতে হবে সবচেয়ে ভালোভাবে।

আরও কিছু বড় সমস্যা রয়েছে। যেমন সংবাদমাধ্যমের জন্য সাংবাদিকসহ উপযুক্ত কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দিন শেষে বাংলাদেশে ছাপা বা গণমাধ্যম—যা-ই বলুন, মিডিয়া তেমন সফল নয়; যেমনটা ধরা যাক ভারতে। এসব সমস্যা একেবারে সমাধান করা যায়নি। আমি নিজে সাংবাদিক, সংবাদদাতা আর সাধারণ পাঠকদের কাছে যাই। শুনতে চাই তাঁরা কী বলেন।

  • ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট সিলেট শুভানুধ্যায়ীদের আয়োজনে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে অংশবিশেষ। বক্তৃতাটির শ্রুতলিখন কিছু পরিমার্জনাসহ প্রকাশিত হয়েছিল আবুল হাসনাত সম্পাদিত শিল্প–সাহিত্যের মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’–এ।