জীবন ও ভাবনা: খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড

সমাজতন্ত্রের আন্দোলন, সমাজতন্ত্রের সাহিত্য পড়াশোনা করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরের শেষে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হলাম। আমার নেতা আবদুল হালিম আমাকে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র শিখার একটি সংখ্যা পড়তে দিয়েছিলেন। খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদদের স্মৃতি নিয়ে শহীদ স্মৃতি সংখ্যা। উইপোকায় খাওয়া সেই সংখ্যাটা এখনো আমার কাছে আছে। ২৪ এপ্রিল ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের উন্মত্ত গুলিবর্ষণে সাতজন বামপন্থী রাজবন্দীর মৃত্যু হয়েছিল। আরও ১৮–২০ জন আহত হয়েছিলেন। সেই ঘটনাটি আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। এসব ভাবতে ভাবতে আমি কিছু কাজ শুরু করলাম আশির দশকে। ’৮২ থেকে ৯০, ৯০ থেকে ৯১–৯২ পর্যন্ত। তার মধ্যে ভোরের কাগজ (১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি) শুরু করলাম, প্রথম আলো  শুরু করলাম ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর। আমার সকল সময় এই দুই পত্রিকার পেছনে চলে গেল। কিন্তু আমি আমার এই চেষ্টার মধ্য দিয়ে কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে যাঁরা ছিলেন—আসামে, জলপাইগুড়িতে অথবা ঢাকায়, পাবনায়, ফরিদপুরে—তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। করতে করতে একপর্যায়ে গিয়ে উদ্যোগটা প্রায় থেমে গেল।

একে একে সেই সময়ের রাজশাহী জেলের বন্দীদের সবাই মৃত্যুবরণ করলেন। নানা ক্ষেত্রে, নানা জায়গায়, নানা সময়ে এই রাজবন্দীদের আত্মত্যাগ নিয়ে ভেবেছি। শেষ পর্যন্ত সেই শহীদ, সেই আহত, সেই বন্দী—যাঁরা বেঁচে ছিলেন এবং তারপরও তাঁদের সারা জীবন দুঃখ–বেদনাগুলো বহন করে চলেছেন, সেই মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না খাপড়া ওয়ার্ডের ঘটনা। সেই স্মৃতি মনে রেখে অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে আমি খাপড়া ওয়ার্ডের সেই নৃশংস, নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে—আমার যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করা ছিল, সেসব কিছু মিলিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছি—নাম খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০। তাঁদের কথা মনে করে বইটা প্রকাশ করতে পেরে মনে একটু তৃপ্তি পাই। কিন্তু দুঃখ এই, এক সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য্য (১৯৩৩-২০১৬) ছাড়া অন্যরা কেউ সেই বইটা দেখে যেতে পারলেন না। তাঁরা খুব করে চেয়েছিলেন অন্ততপক্ষে বইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁদের কথা বাংলাদেশের মানুষের কাছে থেকে যাবে, তাঁদের কথা নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে।

  • ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট সিলেট শুভানুধ্যায়ীদের আয়োজনে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে অংশবিশেষ। বক্তৃতাটির শ্রুতলিখন কিছু পরিমার্জনাসহ প্রকাশিত হয়েছিল আবুল হাসনাত সম্পাদিত শিল্প–সাহিত্যের মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’–এ।